রাজনীতি

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী?

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী?

গণহত্যায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশে চলছে আন্দোলন-সমাবেশ। শাহবাগ ও এর আশপাশে অবস্থান নিয়েছে এনসিপি, জামায়াত, বাংলাদেশ লেবার পার্টিসহ বেশ কয়েকটি ছোট-বড় রাজনৈতিক দল। তবে প্রথম থেকেই অনুপস্থিত দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি।

Advertisement

জনমনে প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিএনপি কেন রাজপথে নেই? আদৌ কি তারা এ দাবির পক্ষে? পক্ষে না থাকলে তারা কী চায়, দল হিসেবে বিএনপির অবস্থান কী? বিষয়টি নিয়ে জানতে কথা হয় দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে। মতামত জানিয়েছেন আন্দোলনে মাঠে থাকা অন্য দলগুলোর নেতারাও।

বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ তারাও চায়। তবে নিষিদ্ধ করার যে প্রক্রিয়া সেটি নিয়ে তাদের দ্বিমত আছে। তবু এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দলের সভায় নির্ধারিত হবে।

নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আমরা নিষিদ্ধের পক্ষে না। আদালতের মাধ্যমে হলে আমাদের আপত্তি নেই। আমরা পুরো বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছি, এ বিষয়ে দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।- বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স

Advertisement

আর অন্য দলগুলো বলছে, বিএনপি সরাসরি কথা না বলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলছে। দল হিসেবে তারা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতেই পারে।

‘আমরা বহু আগেই নিষিদ্ধ চেয়েছি’

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক আমরা বহু আগেই চেয়েছি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যখন বৈঠক হয়েছে তখন আমরা বলেছি মানবতাবিরোধী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের কথা বলেছি। আমাদের অবস্থান লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপদেষ্টা কেবিনেটে তারপরে আর কিছু দেখছি না।’

আরও পড়ুনআইসিটি অ্যাক্টে আ’লীগ নিষিদ্ধের প্রস্তাবনা নিয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছেযারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চায় না তারা ফ্যাসিবাদী: হাসনাত আবদুল্লাহআমরা কোনো দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে না: জি এম কাদের

তবে রাজপথে না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আমরা নিষিদ্ধের পক্ষে না। আদালতের মাধ্যমে হলে আমাদের আপত্তি নেই। আমরা পুরো বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছি, এ বিষয়ে দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’

‘জনগণ চাইলে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবে’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন ফারুক বলেন, ‘জনগণ চাইলে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবে। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিত আমাদের ঐক্য ফাটলের কোনো প্রক্রিয়া কি না সেটাও দেখার বিষয় আছে।’

Advertisement

‘সরকার নিষিদ্ধ করলে করবে’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপি বারবার বলছে, সরকার নিষিদ্ধ করলে করবে, কিন্তু দল হিসেবে আমরা নিষিদ্ধ করতে পারি না।’

বিএনপি অন্যতম ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি। তারা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের ব্যাপারে বিএনপি ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলছে, আমরা আশা করি তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে।- বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান

‘ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে হলেও চায় নিষিদ্ধ’

বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি যৌক্তিক। সরকার তো চাইলে নিষিদ্ধ করতে পারে, কিন্তু তা তো করছে না। আব্দুল হামিদকে কারা দেশত্যাগ করতে দিয়েছে? আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলনের জন্য খালেদা জিয়াকে ডাকা হচ্ছে কেন? তিনি তো নিজের দলীয় রাজনীতিতেই সক্রিয় না। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ দাবিতে বিএনপিকে এত প্যাঁচানো হচ্ছে কেন? বিএনপি কি বলছে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা যাবে না?’

দলীয়ভাবে বিভিন্ন দলের মত ভিন্ন হতে পারে: জামায়াত

বিএনপির অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী যারা আন্দোলনে ছিল তাদের সবাই ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের বিচারের বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এদেশে যাতে ফ্যাসিবাদ আর ফিরে না আসে তার নীতিগত অবস্থান সব দলের মধ্যে রয়েছে। দলীয়ভাবে বিভিন্ন দলের মত ভিন্ন হতে পারে।’

বিএনপি ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলছে: বাংলাদেশ লেবার পার্টি

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে রাজপথে আছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের ব্যাপারে শাহবাগে আন্দোলন চলছে। গত পরশু থেকে জনশক্তি দিয়ে অবস্থান করছি। আমরা মনে করি পিলখানা হত্যাযজ্ঞ, শাপলা চত্বরে হত্যাযজ্ঞ এবং ছাত্র-জনতার যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে আওয়ামী লীগ, তাদের এ কারণে রাজনীতি করার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ও এসব করেছে, লেবার পার্টি নিষিদ্ধ করেছিল।’

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যে কয়েকটি সংগঠন আন্দোলন করছে, এই আন্দোলনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। যারা আন্দোলন করছে তারা নিবন্ধিত কোনো সংগঠন নয়। তাদের সমর্থনে কত মানুষ রয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।- রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের চূড়ান্ত ফয়সালা গত ৫ আগস্ট হয়ে গেছে, এখন চূড়ান্ত পরিপত্রের অপেক্ষা। বিএনপি অন্যতম ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি। তারা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের ব্যাপারে বিএনপি ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলছে, আমরা আশা করি তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে।’

বিএনপির প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিমত: এবি পার্টি

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে বিএনপির নীতিগতভাবে কোনো দ্বিমত নেই, তবে প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। এখন দেখা যাক, আগামীতে মিটিং আছে।’

‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আন্দোলন?’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যে কয়েকটি সংগঠন আন্দোলন করছে, এই আন্দোলনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। যারা আন্দোলন করছে তারা নিবন্ধিত কোনো সংগঠন নয়। তাদের সমর্থনে কত মানুষ রয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে যে মানুষ নেমেছিল, তার ১০ শতাংশ এই আন্দোলনকারীদের সমর্থন করে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’

তিনি মনে করেন, ‘বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সচেতন দল হওয়ায় জানে রাজপথের হঠকারি আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা যায় না। বিএনপি চায় সর্বসম্মতভাবে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিভিন্ন আলোচনায় বলছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে রাজনীতির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী একরকমভাবে মাঠ থেকে বাদ পড়বে, যা বিএনপির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে সুবিধাজনক হতে পারে। তবে এতে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে, যা ভবিষ্যতে বিএনপির নিজস্ব রাজনীতির ক্ষেত্রেও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আর একে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার রূপও দিতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সে ঝুঁকি বিএনপি নিতে চায় না বলেই সরাসরি পথে হাঁটছে না।

এখন সব চোখ বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে, যা শনিবার (১০ মে) রাত সাড়ে ১০টায় ডাকা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই বৈঠকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে দলটি তার পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে।

কেএইচ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম