টিনের কৌটায় রাখা দুধ দিয়ে বিশেষ কায়দায় চলছে মাখন তৈরির প্রস্তুতি। বিশেষ একটি বাঁশের লাঠি দড়ির মাধ্যমে টেনে ভেতরে সৃষ্টি করা হচ্ছে ঘূর্ণন। দুই হাত প্রসারিত করে শারীরিক কসরতে প্রায় আধা ঘণ্টা পর সেই কৌটার মধ্য থেকে বের করে আনা হচ্ছে বাদামি বর্ণের খাটি মাখন। ঘ্রাণ ও স্বাদে যা অনন্য।
Advertisement
এভাবেই সনাতন পদ্ধতিতে যুগের পর যুগ ধরে মাখন তৈরি করে আসছেন শরীয়তপুরের ভোজেশ্বর বাজারের মাখন বিক্রেতা বাসুদেব দাস। বর্তমান যুগে যেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা তৈরি করা হয় মাখন, সেখানে আসল মাখনের স্বাদ ধরে রাখতে এমন প্রচেষ্টা তার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবার পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরতে মাখন তৈরির কাজে যুক্ত হন বাসুদেব। মাসিক দেড়শ টাকা বেতনে বাবু ঘোষ নামের স্থানীয় এক মিষ্টি ব্যবসায়ীর দোকানে কাজ শুরু করেন তিনি। একটানা ১৭ বছর কাজ করেন সেখানে। ওস্তাদ বাবু ঘোষ তাকে নিজ হাতে শিখিয়েছিলেন মাখন তৈরির কাজ। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে নিজেই বাজারের কাপড়পট্টি চৌধুরী সুপার মার্কেটে দোকান ভাড়া নিয়ে বিক্রি শুরু করেন আটার রুটি মাখন। এক সময় বাবু ঘোষের দোকান বন্ধ হয়ে গেলেও বাসুদেব মাখন তৈরির কাজ ধরে রেখেছেন। সকাল থেকে দুপুর ও বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে তার দোকানে মাখন ও আটার রুটি বেচাকেনা। এছাড়াও পাশাপাশি পাওয়া যায় হালুয়া, ডালভাজি ও ডিম।
বাসুদেব জানান, খাঁটি মাখন তৈরিতে যেমন প্রয়োজন হয় খাঁটি দুধ আর তেমনি ধৈর্যের সঙ্গে করতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। প্রথমে দুধকে নির্দিষ্ট তাপে জ্বাল দিয়ে একটি জায়গায় নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে সেগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করে টিনের কৌটার মধ্যে রেখে বরফ দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে রশি টেনে তৈরি করেন মাখন। একদিন অন্তর অন্তর তার দোকানে মাখন তৈরি হয়। তিনি মাখন তৈরির দুধ সংগ্রহ করেন নড়িয়ায় বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে বিশ্বস্ত দুধ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। আর সেই খাটি দুধ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করেন মাখন।
Advertisement
তিনি জানান, এক মণ দুধ থেকে তৈরি হয় ৫ কেজি সমপরিমাণ মাখন। আর এই মাখন খেতে প্রতিদিন সকালে তার দোকানে ভিড় জমান ভোজনরসিকরা। তার মাখনের সুনাম রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। তাই অন্যান্য এলাকা থেকে তার দোকানে এসে অনেকেই মাখন নিয়ে যান।
জানা যায়, মাখনে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন এ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এজন্য অনেক রোগীর লোকও বাসুদেবের দোকান থেকে মাখন নিয়ে যান। এভাবে পুরাতন ঐতিহ্য ধরে রেখে মানুষের মাঝে নির্ভেজাল মাখন ছড়িয়ে দিতে পেরে মানসিকভাবে খুশী এই মাখন বিক্রেতা। ভোজনরসিকরাও তার দোকানের মাখন খেয়ে প্রশংসা করেন।
আরও পড়ুন নিয়মিত মাখন খেলে কী হয়? রসে টসটসে খেতে সুমিষ্ট মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু সংগঠন না থাকায় শ্রমিক বলেও গণ্য হন না কৃষকরাস্থানীয় বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব খালেক প্যাদা জানান, ছোট বেলা থেকে ভোজেশ্বর বাজারে বাবার সঙ্গে বাবু ঘোষের দোকানের মাখন খেতেন। এরপর দোকানটি বন্ধ হল সেই দোকানের কর্মচারী বাসুদেব দাসের দোকানের মাখন খান তিনি। গরুর খাঁটি দুধ আর সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া এই মাখন যেমন স্বাদ শরীরের জন্যও তেমন উপকারী, এমনটাই বলেন তিনি।
খালেক প্যাদা বলেন, বাসুর দোকানের মাখন তৈরির দুধ চর থেকে সংগ্রহ করা হয়। নির্ভেজাল দুধ আর চরকায় টেনে বানানো এই মাখন অনেক সুস্বাদু। মাখন শরীরের জন্য খুবই উপকারী। বাসুর দোকানে মাখনের খুব সুনাম আছে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এসে এই মাখন কিনে নিয়ে যান।
Advertisement
শাওন হাওলাদার নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমি প্রতিদিন সকালে এই দোকানে আটার রুটির সঙ্গে মাখন খাই। অন্যান্য দোকানে যেখানে ব্লেন্ডার মেশিনে মাখন তৈরি করে সেখানে বাসুদার দোকানে নিজ হাতে চরকায় মাখন তৈরি করে। এজন্য মাখনের স্বাদ এবং গুণাগুণ ভালো থাকে। আমার বন্ধুরা এলে তাদের মাঝেমধ্যে এই দোকানে মাখন খাওয়াতে নিয়ে আসি। যাতে ওরা আসল মাখনের স্বাদ পায়।
শ্যামল চন্দ্র দাস নামের এক স্কুল শিক্ষক বলেন, আমি পাঁচ বছর ধরে এই দোকানে সকাল ও সন্ধ্যায় মাখন দিয়ে রুটি খাই। এই বাজারে একমাত্র তার দোকানই রয়েছে যেখানে সনাতন পদ্ধতিতে মাখন তৈরি হয়। মাখন আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। মাখনে ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন রয়েছে। তাছাড়া খাঁটি মাখন খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে।
মাখনের কারিগর বাসুদেব দাস বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে মাখন তৈরি কষ্টকর। তবে আমি খাঁটি মাখন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এখনও সেই আগের মতো যেভাবে ওস্তাদের কাছে শিখেছিলাম সেভাবে মাখন তৈরি করছি। এখন আর মানুষ কষ্ট করে প্রাচীন পদ্ধতিতে মাখন বানায় না। কেউ ব্লেন্ডার করেন, আবার কেউ কেমিক্যাল ব্যবহার করেন। আমার দোকানের মাখন খাঁটি হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন মাখন খেতে। যতদিন সম্ভব আমি এভাবেই মাখন তৈরি করে যাবো।
বিধান মজুমদার অনি/এমএন/জিকেএস