অর্থনীতি

কৃষিখাতে সুনির্দিষ্ট প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দরকার

কৃষিখাতে সুনির্দিষ্ট প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দরকার

মোট দেশীয় উৎপাদনে (জিডিপি) সার্বিক কৃষিখাতের (শস্য উপখাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপখাত এবং বন উপখাত নিয়ে সার্বিক কৃষিখাত গঠিত) অবদান কমলেও এখনো কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান জীবনীশক্তি। আসন্ন বাজেটে অন্য খাতের মতো কৃষিখাত সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশাও একটু বেশি। তারা চান বৈষম্যহীন ও অগ্রাধিকারমূলক একটি বাজেট।

Advertisement

কৃষিখাতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ দরকার। পাশাপাশি সার্বিক কৃষিখাতে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের (ইউজিভি) উপাচার্য এবারের বাজেট নিয়ে কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাজমুল হুসাইন।

দেশে বর্তমানে যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি তার বড় কারণ কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়া। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে।

জাগো নিউজ: বিগত বেশ কয়েক বছর একই ধরনের কৃষি বাজেট দেওয়া হচ্ছে, তাতে খুব বেশি উন্নয়ন হচ্ছে না। কৃষি বাজেটে কী ধরনের পরিবর্তন দরকার বলে আপনি মনে করছেন?

Advertisement

জাহাঙ্গীর আলম খান: দেখুন, স্বাধীনতার পরের বাজেটগুলোতে কিন্তু কৃষিখাত কোন লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে সেটা নির্ধারণ করে একটি প্রবৃদ্ধির হার ঠিক করা থাকতো। যেমনভাবে জাতীয় বাজেটের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থাকে। বিগত ১৫-২০ বছর কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি উল্লেখ থাকছে না, কারণ সেটা অর্জন করা যায় না। কিন্তু এগিয়ে যেতে হলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা দরকার।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যেটা আছে, তাতে কৃষিখাতে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল, সেটা অর্জন হয়নি। হয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু আমরা যদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) করতে চাই, তাহলে খাদ্য ও পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাগবে। সেজন্য বেশি সময় নেই। সবকিছু বিবেচনায় নিলে এবার বাজেটে প্রথম কাজ কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে (২০২৪-২৫) আগের বছরের বাজেটের চেয়ে ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা ভর্তুকি কমানো হয়েছে। এই যে কমে গেছে, তাতে কিন্তু উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমেছে। কৃষিতে ভর্তুকি কমানো কোনোভাবেই কাম্য নয়।

জাগো নিউজ: খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়টি কি কৃষি বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত?

Advertisement

জাহাঙ্গীর আলম খান: দেশে বর্তমানে যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি তার বড় কারণ কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়া। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে। গত বছরের জুলাইয়ে কিন্তু মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছিল, কারণ তখন চরম খরা ও প্রাকৃতিক কারণে উৎপাদন কম হয়েছিল। এরপর যখন রবিশস্য উৎপাদন হলো তখন কিন্তু সেটা কমে এখন ১০ শতাংশের নিচে এসেছে। উৎপাদন ভালো হলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে।

আরও পড়ুন বাজেট ২০২৫-২৬/কৃষিপণ্য সরবরাহে উৎসে কর কমাতে ‘ইতিবাচক’ এনবিআর  করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না, সুবিধা হারাতে পারে বড় রপ্তানি খাত  সেমিনারে বক্তারা/বাজেটে কৃষির হিস্যা বাড়াতে হবে  আলু রপ্তানিতে ফের সুবাতাস 

আমাদের সমসাময়িক সময়ে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানেও কিন্তু মূল্যস্ফীতি প্রচুর বেড়েছিল। তারা কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণ করে শূন্যের কোটায় এনেছে। আমরা কিন্তু ততটা পারিনি। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে এ মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে নেমে আসা উচিত। এটার একমাত্র হাতিয়ার উৎপাদন বাড়ানো, যে জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

সহায়তা ছাড়া রপ্তানিকারকদের সক্ষমতায় চাপ তৈরি হবে। আমরা বিদেশের অন্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবো না। এছাড়া রপ্তানি কমে গেলে অনেক পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়।

জাগো নিউজ: বাজেটে কৃষির বরাদ্দ কত হওয়া উচিত?

জাহাঙ্গীর আলম খান: দেশের সার্বিক বাজেটের আকার ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে হিসাব করলে দেখবেন, ওই সময়ের চেয়ে এখন (২০২৪-২৫ অর্থবছর) মোট বাজেটের আকার ৪ দশমিক ৮৭ গুণ বেড়েছে। কিন্তু সেভাবে কৃষিখাতের বরাদ্দ বাড়েনি। ওই সময়ের তুলনায় এখন কৃষি বাজেট বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৮ গুণ। আবার ওই অর্থবছর (২০১১-১২) কৃষি বাজেট মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ ছিল, যেটা এখন মাত্র ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, দেশের সার্বিক বাজেট বাড়লেও কমছে কৃষি বাজেট। এ বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১০ শতাংশের ওপরে হওয়া উচিত।

জাগো নিউজ: অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার চাপে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে ব্যয় সংকোচন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৃষিতে ভর্তুকি কমলে কী সমস্যা হবে?

জাহাঙ্গীর আলম খান: যে হিসাব বলছিলাম, তা থেকেই দেখুন, ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ ভর্তুকি ছিল। যেটা এখন মাত্র ২ দশমিক ১৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে (২০২৪-২৫) আগের বছরের বাজেটের চেয়ে ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা ভর্তুকি কমানো হয়েছে। এই যে কমে গেছে, তাতে কিন্তু উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমেছে। কৃষিতে ভর্তুকি কমানো কোনোভাবেই কাম্য নয়। বরং এটি বাড়িয়ে কমপক্ষে ৫ শতাংশ করতে হবে।

জাগো নিউজ: বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন কোন খাতে নজর দেওয়া দরকার?

জাহাঙ্গীর আলম খান: কৃষিতে গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উপকরণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এছাড়া কৃষক যখন ফসলের দাম পায় না, তখন প্রাইস সাপোর্ট (মূল্য সহায়তা) দিতে হবে। দাম না পেলে কৃষক সফল উৎপাদনের আগ্রহ হারাবে।

জাগো নিউজ: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বাজেটে এর প্রতিফলন দরকার?

জাহাঙ্গীর আলম খান: বছরজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ, তাপপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের মধ্যে পড়ে আছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে শস্য উপখাতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এ আঘাত সবচেয়ে বেশি কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ খাতে আলাদা বরাদ্দ থাকে বাজেটে। যেখান থেকে কৃষিতে মাত্র ৪-৫ শতাংশ খরচ হয়। কিন্তু ওই বরাদ্দে ৪০ শতাংশ কৃষিখাতে দেওয়া দরকার।

জাগো নিউজ: এ খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কী করতে হবে?

জাহাঙ্গীর আলম খান: বাজেটের সবচেয়ে বড় ইস্যু হচ্ছে, আপনি কোথায় কত টাকা বরাদ্দ দিচ্ছেন। অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ দিয়ে মূল্যস্ফীতি কখনো থামাতে পারবে না সরকার। একমাত্র আদিকাল থেকে উৎপাদনশীল সেরা খাত কৃষি। তবে এ খাতে ক্রমাগত বিনিয়োগ কমছে, উল্টোপথে যাওয়া এ গতি রোধ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করতে হবে।

জাগো নিউজ: কৃষিপণ্য রপ্তানি নিয়ে কোন ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন?

জাহাঙ্গীর আলম খান: সরকার আগে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বেশ ভালো নগদ সহায়তা দিতো। সেটা দিন দিন কমে ১০ শতাংশে নেমেছে, কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে। তবে চাইলে বড় প্রণোদনা অব্যাহত রাখার সুযোগ রয়েছে। সহায়তা ছাড়া রপ্তানিকারকদের সক্ষমতায় চাপ তৈরি হবে। আমরা বিদেশের অন্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবো না। এছাড়া রপ্তানি কমে গেলে অনেক পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়।

পাশাপাশি উত্তম কৃষিচর্চার ব্যবস্থা, ভালোমানের প্যাকেজিং ও বৈচিত্র্যময় পণ্য নিয়ে আসতে রপ্তানিকারক ও উৎপাদনকারীদের সহায়তা করতে হবে। তারা যাতে সঠিকভাবে ও সাশ্রয়ী খরচে পণ্য বিদেশে পৌঁছাতে পারে সেজন্য কার্গো স্পেস নিশ্চিত করতে হবে, ভাড়া কমিয়ে দিতে হবে। এগুলোর সদিচ্ছা সরকারের থাকা উচিত।

এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস