কয়েকদিন পরই গ্রামজুড়ে চলবে লিচু ভাঙার মহোৎসব। রসাল, সুমিষ্ট ও গাঢ় লাল রঙের কারণে লিচুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। অনুকূল আবহাওয়ায় এবার লিচুর ফলনও হয়েছে আশানুরূপ। এবার ১০ কোটি টাকা লিচু বাণিজ্যের আশা করছেন চাষিরা।
Advertisement
বলছিলাম কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া পৌর এলাকার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর কথা। গ্রামের নামেই লিচুর নাম রাখা হয়েছে ‘মঙ্গলবাড়িয়া লিচু’।
স্থানীয় বাজারে অনেক জাতের লিচু উঠলেও ক্রেতাদের চোখ থাকে রসে টসটসে সুস্বাদু মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর দিকে। এ লিচুর স্বাদ নেওয়ার জন্য মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে ভিড় করেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্রেতারা।
বাগানেই এ লিচু বিক্রি হয় চড়া দামে। প্রতি একশ লিচু বর্তমানে বিক্রি হয় ৬০০ টাকায়। মঙ্গলবাড়িয়ার বেশিরভাগ লিচু বাগানই আগাম বিক্রি হয়ে যায়। কিছু পাইকার অগ্রিম গাছ কিনে অতিরিক্ত দামে লিচু বিক্রি করেন। এবারও ভালো দাম পাবেন বলে আশা করছেন চাষি ও পাইকাররা।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২০০ বছর আগে সুদূর চীন থেকে কোনো এক ব্যক্তি প্রথমে একটি চারাগাছ এনে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার পৌর এলাকা মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে রোপণ করেন। অধিক ফলন ও রসে টসটসে ছোট বিচির কারণে এ লিচুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন এলাকাবাসী। কিছু দিনের মধ্যেই এ জাতের লিচুর কলম চারা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে। লাভজনক হওয়ায় দ্রুতই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন গ্রামবাসী। বর্তমানে এলাকার বাড়িতে বাড়িতে শোভা পাচ্ছে এ জাতের লিচুর গাছ।
পাকুন্দিয়া উপজেলার কৃষি অফিসের তথ্যমতে, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রায় ২০০টি পরিবার লিচুচাষের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া এই জাতের লিচু আশপাশের গ্রাম কুমারপু, নারান্দী ও হোসেন্দীতে বিস্তার লাভ করেছে। এবছর বাগানগুলো থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রির আশা করছেন চাষিরা।
আরও পড়ুন: দেশি লিচু এবার আকারে ছোট, স্বাদেও টক পাকা ও মিষ্টি লিচু চিনবেন যেভাবে ঈশ্বরদীর হাট-বাজারে অপরিপক্ব লিচু, দামও চড়ালিচু চাষি সফির উদ্দিন জানান, তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে লিচু চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনিও লিচু চাষ করেন। তার ৫০-৬০টি লিচুগাছ রয়েছে। লিচু চাষ করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। প্রতিবছর এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করেন। এর পাশাপাশি তার রয়েছে মৌ খামার ও লিচুর চারা উৎপাদনের ব্যবসা।
স্থানীয় লিচু ব্যবসায়ী তৌহিদ মিয়া বলেন, ‘আমি ১০৫টি গাছ দুই লাখ টাকায় কিনেছি। পরিচর্যায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখানে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি। কারণ এ লিচু নিয়ে বাজারে যাওয়া লাগবে না, গাছতলাতেই বিক্রি হয়ে যাবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ লিচু কিনতে এ গ্রামে আসবেন।’
Advertisement
কথা হয় মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে লিচু কিনতে আসা আশিকুজ্জামান আশিকের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি প্রতি বছরই লিচু কিনতে মঙ্গলবাড়িয়া আসি। এ লিচু খেতে অনেক সুস্বাদু ও মজা।’
সোনিয়া আক্তার নামের আরেকজন বলেন, ‘লোকমুখে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর অনেক প্রশংসা শুনেছি। তাই এবার লিচু কিনতে সরাসরি মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে এসেছি। প্রশংসা যেমন শুনেছি আসলে তেমনই রসে টসটসে সুস্বাদু এ লিচু।’
নরসিংদী থেকে মঙ্গলবাড়িয়ায় লিচু কিনতে আসা চাকরিজীবী জাকারিয়া হোসেন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মঙ্গলবাড়িয়ার সুস্বাদু লিচুর খবর পেয়ে লিচু কিনতে নরসিংদী থেকে এসেছি। লিচু বাগানে বসে অনেক লিচু খেয়েছি। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের জন্যও লিচু কিনেছি।’
স্থানীয় লিচুর ব্যাপারী মো. মামুন মিয়া বলেন, ‘পাঁচ বছর প্রবাসে ছিলাম। ছুটিতে বাড়িতে এসেই লিচু ব্যবসা শুরু করে দিয়েছি। আমার মতো স্থানীয় অনেক যুবকই এই মৌসুমে লিচু ব্যবসা করে লাভবান হন।’
মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচু সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান হেলাল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের পরিবারে ৪৫টি লিচুগাছ রয়েছে। এই মৌসুমে লিচু বিক্রি আমাদের বাড়তি আয়ের উৎস। গ্রামে প্রতি বছরই নতুন নতুন বাগান হচ্ছে। অনেকে জমির চারপাশের আইলে লিচুগাছ রোপণ করে বাগান সৃষ্টি করছেন।
পৌরসভার উপসহকারী কৃষক অফিসার মাইদুল হক জানান, এবার মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচু চাষিদের নিয়ে লিচু সমিতি করা হয়েছে। এই সমিতির মাধ্যমিক কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে লিচু চাষ বিষয়ে কর্মশালা করা হয়েছে। আরও তিনজন উপসহকারী কৃষি অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যাতে কৃষকরা উপকৃত হন।
পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার নূর-ই-আলম জানান, মঙ্গলবাড়িয়ার মাটি লিচু চাষের জন্য উপযোগী। এ গ্রামের উৎপাদিত লিচু অত্যন্ত সুস্বাদু। প্রতিটি লিচুই গোলাপি রঙের। শাঁস মোটা, রসে ভরপুর, গন্ধও অতুলনীয়।
তিনি আরও জানান, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রায় ২০০টি পরিবার লিচু চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এছাড়া আশপাশের গ্রাম কুমারপুর, নারান্দী ও হোসেন্দীতেও লিচু চাষ হচ্ছে। এবছর বাগানগুলো থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি করতে পারবেন চাষিরা। উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে লিচু উৎপাদনের ক্ষেত্রে চাষিদের যাবতীয় পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
এসআর/এএসএম