মতামত

বিধ্বস্ত মানবতা কেন এই নৃশংসতা?

বিধ্বস্ত মানবতা কেন এই নৃশংসতা?

সমাজে প্রতিদিনই মারাত্মক সব সহিংসতা ঘটছে। মাত্রাগত ও প্রকৃতিগত দিক থেকেও মানুষের নৃশংসতা ও সামাজিক সহিংসতার রূপ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিই যে নির্মম বাস্তবতা তা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনাগুলোর শিরোনাম-ছবি দেখলেই বোঝা যায়। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে কুপিয়ে হত্যা, ঘুমের মধ্যে শিশুহত্যা, সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন কিংবা জন্মদাত্রী মায়ের হাতে সন্তান খুন কিছুই আর অবিশ্বাস্য মনে হয় না এখন!

Advertisement

স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, স্বামী পুড়িয়ে মারছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, রাস্তায়, বালুর ভেতর, বস্তার ভেতর, কাদার ভেতর, পানির ট্যাঙ্কে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের খুনের ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনাপ্রবাহে একসময় জানা যাচ্ছে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব কিংবা সম্পত্তির বিরোধ এমন বেশিরভাগ হত্যার কারণ। কিন্তু সমাজ কেন এতটা সহিংস হয়ে উঠছে, মানুষ কেন এতটা নৃশংস হয়ে উঠছে তার উত্তর কি আমরা অনুসন্ধান করছি?

নানা পারিপার্শ্বিকতায় বর্তমানে সমাজ ও পরিবারে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। মানুষের ধৈর্য কমে গেছে। মানবিক মূল্যবোধ কমে গেছে। অন্যদিকে বেড়েছে লোভ আর হিংসা। এসব কারণে একশ্রেণির মানুষ অনেক কিছুই সহজে মেনে নিতে পারেন না। ফলে ঘটছে হত্যার মতো নৃশংস সব ঘটনা।

উদ্বেগজনক হারে দেশে আকস্মিকভাবে বেড়েছে অপরাধমূলক ঘটনা। লোভ-লালসা, নারী ও সম্পত্তি নিয়ে বিরোধসহ বিভিন্ন নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। আকস্মিকভাবে পারিবারিক ও সামাজিক হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণও রয়েছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। এসব হত্যাকাণ্ড আগেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। তবে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়াটা সমাজের জন্য ভালো কোনো বার্তা নয়।

Advertisement

মানতেই হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। কুমিল্লা শহরে দিনের বেলা তিন শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সশস্ত্র মহড়াই তার একটা প্রমাণ। তা ছাড়া অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও চোখে পড়ছে না। সবকিছু মিলিয়ে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। এসব অপরাধ বাড়ছে পারিবারিক কলহের জেরে। সন্তান খুন করছে জন্মদাতা বাবাকে। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন হচ্ছে অথবা স্ত্রীর হাতে স্বামী।

চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৮৭০টি। এদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০টি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটেছে ১ হাজার ৪৩০টি। চলতি মার্চ মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। সারা দেশে নারী বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।

দুই মাসে ৩০০-এর বেশি পারিবারিক বিরোধে খুন হয়েছেন, নারী-শিশু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৮৭০টি। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৮৭০টি। এদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০টি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটেছে ১ হাজার ৪৩০টি। চলতি মার্চ মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। সারা দেশে নারী বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।

ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিন জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুই জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে।এর বাইরে গত কয়েক দিনে এ ধরনের বেশ কিছু পারিবারিক নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব এসব ঘটনা বৃদ্ধির জন্য কোনোভাবে দায়ী কি না, জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা মিডিয়াকে বলেছেন, এর কিছুটা প্রভাব হয়ত পড়ে। কিন্তু সেটিই প্রধান বা অন্যতম কারণ নয়। এর সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার অভাব, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সাংসারিক অভাব-অনটনসহ নানা ধরনের বিষয় থেকে চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটে থাকে। সেখান থেকেই হিংস্রতা-নৃশংসতা বেশি ঘটে। হঠাৎ করেই মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই পরিবর্তন বেশির ভাগই নেতিবাচক। কামনা-বাসনা, চাহিদা অতিমাত্রায় পোষণ করছে মানুষ। এর সবকিছুই যে পূর্ণ হবে তা নয়। এর কোনোটির ব্যত্যয় দেখা দিলে ভয়ানক কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে তারা।

Advertisement

ইন্টারনেটভিত্তিক গেম আসক্তিতেও ভুগছে অনেকে। এটি মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত ২২ মার্চ রাতে চুয়াডাঙ্গায় নামাজরত বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করে ছেলে। কারণ, গেমে আসক্ত ছেলের হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছে। এ জাতীয় বেশ কিছু ঘটনা সম্প্রতি সমাজ ও পরিবারে উদ্বেগ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নানা পারিপার্শ্বিকতায় বর্তমানে সমাজ ও পরিবারে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। মানুষের ধৈর্য কমে গেছে। মানবিক মূল্যবোধ কমে গেছে। অন্যদিকে বেড়েছে লোভ আর হিংসা। এসব কারণে একশ্রেণির মানুষ অনেক কিছুই সহজে মেনে নিতে পারেন না। ফলে ঘটছে হত্যার মতো নৃশংস সব ঘটনা। এ জাতীয় ঘটনা শুধু আইন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ঠেকানো সম্ভব নয়। এর জন্য সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঠিক চর্চাও খুব জরুরি।

এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পরিবার ও সমাজের দায় রয়েছে। ধর্মীয় নৈতিকতার শিক্ষা, সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষার চর্চা বাড়াতে হবে। সন্তানদের মানসিক বিকাশে কাউন্সেলিং করা জরুরি, যা উন্নত দেশগুলোতে হয়ে থাকে। সন্তানদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পারিবারিক বন্ধন মজবুত করতে পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকতে হবে। সেই সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও থাকতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক এমন নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে নৃশংসতা অনেকটাই কমে আসবে। সর্বোপরি নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়িয়ে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

সামাজিক অপরাধপ্রবণতা রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক প্রতিরোধও দরকার। এই ক্ষেত্রে সামাজিক অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতার কারণ অনুসন্ধান এবং তা দূরীকরণে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। দরকার পারিবারিক, সামাজিক ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধের চর্চা। সুস্থ মানস গঠনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সবাইকে আরো মনোযোগী হতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস