কৃষি ও প্রকৃতি

কেমিক্যাল আতঙ্ক নয়, চাই বিজ্ঞানসম্মত আমচাষ ও প্রশাসনিক সচেতনতা

কেমিক্যাল আতঙ্ক নয়, চাই বিজ্ঞানসম্মত আমচাষ ও প্রশাসনিক সচেতনতা

মো: তাইফ আলী

Advertisement

বাংলাদেশে এখন আমের মৌসুম। এ সময়টায় কৃষকের চোখে-মুখে থাকে আশার আলো। সারা বছরের পরিশ্রমে ফলানো ফসল বিক্রি করে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কিছু ভুল ধারণা ও অজ্ঞতার কারণে ‘কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো’ অভিযোগে টনকে টন আম প্রশাসনের হাতে জব্দ ও ধ্বংস হচ্ছে। সদ্য সাতক্ষীরায় প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কেজি আম ধ্বংস করা হয়েছে, শুধু ‘রাসায়নিক দিয়ে পাকানো’ অভিযোগে।কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই অবস্থান কি বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিপূর্ণ?

আম পাকানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, এমনকি বাংলাদেশেও, কিছু অনুমোদিত ফল পাকানো রাসায়নিক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইথোফন। এটি বাজারে রাইপেনার বা প্লান্ট গ্রোথ হরমোন (পিজিআর) নামে পরিচিত। এটি একটি উদ্ভিদ বিকাশ নিয়ন্ত্রণকারী পদার্থ, যা ব্যবহারে ফল দ্রুত ও অভিন্নভাবে পাকতে সাহায্য করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং কোডেক্স অ্যালিমেন্টেরিয়াস কমিশন ইথোফনকে অনুমোদিত রাইপেনার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ইথোফন নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে থাকলে এটি নিরাপদ। আমে ইথোফনের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা (MRL) হলো 2.0 mg/kg।

Advertisement

আমাদের দেশের কৃষকরা এখনও অনেকে পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি মেনে রাইপেনার প্রয়োগ করেন না। অনেক সময় তারা প্রয়োগের নিয়ম বা পরিমাণ সম্পর্কে বিস্তারিত না জানলেও, বিভিন্ন ল্যাব পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে—এমন অবস্থাতেও ইথোফনের কোনো ক্ষতিকর রেসিডিউ ভোজ্য অংশে পাওয়া যায় না। কারণ এটি পানিতে দ্রবণীয়, দ্রুত ভেঙে যায় এবং মূলত ফলের বাইরের আবরণে সীমাবদ্ধ থাকে।

আমের খোসা ফেলে দিলে বা ধুয়ে খেলে এর ঝুঁকি প্রায় শূন্যের সমান। আমরা বিগত সময়ে মধুপুরের আনারসে ইথোফনের রেসিডিউ পরীক্ষা করেছি এবং সেখানে ভোজ্য অংশে কোনো রেসিডিউ পাওয়া যায়নি।

তাহলে প্রশ্ন হলো—শুধু ‘কেমিক্যাল’ শব্দটি শুনেই ফল ধ্বংস করা কি যুক্তিসঙ্গত?

নিশ্চয়ই নয়। কারণ এখানে ‘কেমিক্যাল’ বললেই তা ক্ষতিকর হয়ে যায় না। মূল কথা হলো কোন রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়েছে, কী মাত্রায় হয়েছে এবং সেটা মানবদেহের জন্য নিরাপদ কি না—এই প্রশ্নগুলোর বৈজ্ঞানিক উত্তর জানতে হবে।

Advertisement

সমস্যা হলো—প্রশাসন ও জনসাধারণের এক শ্রেণি এখনও মনে করেন, কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো মানেই ক্ষতিকর। এ ভুল ধারণা থেকেই যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়া শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে কৃষকের আম ধ্বংস করা হয়। আর এই বিশ্লেষণ ছাড়া শুধু অনুমান বা সন্দেহের ভিত্তিতে কৃষকের দিনের পর দিন শ্রম দিয়ে উৎপাদিত ফল ধ্বংস করা ন্যায়সংগত নয়। এই ধরনের নির্বিচার ধ্বংস দেশের কৃষি অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাহলে করণীয় কী?

আমাদের উচিত হবে প্রশাসন, কৃষক ও জনগণের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রশাসন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারেন:

১। প্রথমত, প্রশাসনকে বুঝতে হবে—প্রতিটি জব্দ করা আমকে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

২। যদি দেখা যায় আমে ইথোফনের উপস্থিতি অনুমোদিত মাত্রার নিচে বা ভোজ্য অংশে নেই, তাহলে সেই আম ন্যায্যভাবে বাজারজাত করতে দেওয়া উচিত।

৩। আর যদি ফলগুলো বিক্রির অনুপযুক্ত হয়, তাহলে তা বিনষ্ট করার বদলে শিল্পপ্রক্রিয়াজাত খাদ্যে ব্যবহার (যেমন, আচার) বা পশুখাদ্য, জৈব সার উৎপাদন হিসেবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে—যাতে সম্পদ ও পরিবেশ দুই-ই সুরক্ষিত থাকে।

৪। চাষিদের জন্য নিরাপদ রাইপেনার ব্যবহারে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশে নিরাপদ ফল পাকানোর চেম্বার নিয়ে গবেষণা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোয় নিরাপদভাবে ফল পাকানোর জন্য সরকারিভাবে চেম্বার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে যাতে করে কৃষকরা সুলভমূল্যে বিভিন্ন ধরনের ফল নিরাপদ উপায়ে পাকানোর ব্যবস্থা করতে পারে।

৫। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি।

সর্বোপরি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিজ্ঞানসম্মত মূল্যায়নের আগে কোনো খাদ্যকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচনা করা উচিত নয়। এটা যেমন কৃষকের প্রতি অন্যায়, তেমনি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এক ধরনের প্রশাসনিক ব্যর্থতা।

আমাদের এখন প্রয়োজন আতঙ্ক নয়, বৈজ্ঞানিক সচেতনতা, বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ এবং সমন্বিত নীতিমালা। কৃষক, প্রশাসন ও জনগণের যৌথ উদ্যোগেই নিরাপদ, টেকসই ও সুষ্ঠু খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

লেখক: মো: তাইফ আলী, গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ

এমএমএআর/এএসএম