• এডিস মশা থেকে বাঁচতে দিনে-রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমান• দুদিনের বেশি জমা পানি ফেলে দিন• জ্বরে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করান, প্রচুর পানি পান করুন• বেশি দুর্বল লাগলে হাসপাতালে যান
Advertisement
থেমে থেমে হচ্ছে বৃষ্টি, আবার দেখা দিচ্ছে রোদ। এই গরম, এই শীতল অনুভূতি। প্রকৃতির এমন খেয়ালি আচরণে মৌসুম শুরুর আগেই চোখ রাঙাতে শুরু করেছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু সংক্রমণ। মে মাসের প্রথম পাঁচ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় দুইশ জন। এপ্রিল মাসে ছিল সাত শতাধিক। জ্বর হলেই পরীক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং মারা যান ৫৭৫ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়, এরপর ঢাকা উত্তর সিটিতে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই আক্রান্ত দুই হাজার সাতশ জনের বেশি এবং মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। চলতি মাসের প্রথম পাঁচ দিনে আক্রান্ত ১৮৭ জন হলেও এখনো কেউ মারা যাননি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— এটি গৃহস্থালি মশা, ঘরেই বেশি থাকে। সুতরাং ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টব, ছাদ ও বাসার চারপাশে যেখানে পানি জমে সেখানে মশা ডিম পাড়ে ও বংশবৃদ্ধি করে। পানি যেন কোথাও দুদিনের বেশি জমে না থাকে।- অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
Advertisement
এ বছর আক্রান্তের দিক থেকে বরিশাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি এগিয়ে। মৃত্যুর হারেও এগিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে আক্রান্ত তুলনামূলক কম হলেও মৃত্যু কিছুটা বেশি ছিল—মোট মৃত্যু ছিল ২৯ জনের।
আরও পড়ুনডেঙ্গু পরবর্তী সময়ে যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারেডেঙ্গু নাকি সাধারণ জ্বরে ভুগছেন বুঝবেন কীভাবে?বছরজুড়ে ডেঙ্গুতে ৫৭৫ মৃত্যু, শনাক্ত লাখের বেশিপরিত্যক্ত পণ্য কিনে ডিএনসিসির ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম বন্ধবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে এডিস মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শুধু প্রশাসন নয়, নাগরিকদেরও সচেতনতা জরুরি। নিজের বাসা ও আশপাশে দুদিনের বেশি পানি জমতে না দেওয়া এবং ঘুমানোর সময় মশারি টানানো আবশ্যক। সিটি করপোরেশনগুলোর এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। না হলে এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে ডেঙ্গু সংক্রমণ কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে।
এই আশঙ্কা মাথায় রেখেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট চালুর আহ্বান জানিয়েছেন। ডিএনসিসির সব নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং মাতৃসদনে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ডেঙ্গু রোধে চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শঅধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গুর শত্রু আমরা সবাই চিনি—এডিস মশা। এটি এক সময় শহরে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। বরং শহরের বাইরেই এখন বেশি। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে মশা বাড়ছে। জমা পানিতে মশা ডিম পাড়ে এবং বংশবৃদ্ধি করে। এই মশা আপনার-আমার ঘরে আসে।’
Advertisement
জ্বর হলে এক-দুদিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে। না হলে কাছাকাছি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও পরীক্ষা করানো যাবে। জ্বর হলে প্রচুর পানি বা নানান ধরনের জুস পান করতে হবে। দুর্বলতা অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— এটি গৃহস্থালি মশা, ঘরেই বেশি থাকে। সুতরাং ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টব, ছাদ ও বাসার চারপাশে যেখানে পানি জমে সেখানে মশা ডিম পাড়ে ও বংশবৃদ্ধি করে। পানি যেন কোথাও দুদিনের বেশি জমে না থাকে।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের মূল কাজ হলো— মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। এটি প্রশাসনের একার দায়িত্ব নয়। যার যার ঘরবাড়ি, নিজেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘরের বাইরেও মশা মারার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাস্তার ধারে, পরিত্যক্ত টায়ার, চিপসের প্যাকেটসহ নানান জায়গায় পানি জমে থাকে— এসব সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রশাসনকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণকে খেয়াল রাখতে হবে, মশার কামড় থেকে নিজেকে যেন যতটা সম্ভব রক্ষা করা যায়। দিনে-রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। ছোট বাচ্চারা যেন হাফপ্যান্ট না পরে, ফুল প্যান্ট পরাতে হবে। মশার কামড় থেকে রক্ষা পেলে আমরা নিজেকে, পরিবারকে, সমাজ ও দেশকে রক্ষা করতে পারবো।’
ডা. আব্দুল্লাহ আরও পরামর্শ দেন, ‘সবাই খেয়াল রাখবেন—জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা ও গায়ে র্যাশ উঠলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সিরিয়াস হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তখন অনেক কিছুই করার সুযোগ থাকে না। তবে বাসায় থাকলে প্রচুর পানি, ডাব, ওরস্যালাইন, গ্লুকোজ, ফলমূলের রস খেতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই ডেঙ্গু বাড়ে। এবার ইতোমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হলো এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। কেউ বহুতল ভবনে বসবাস করলে সেখানেও পানি জমে থাকলে ফেলে দিতে হবে। ঘরের ভেতরেও যেন পানি না জমে। অনেকেই প্লাস্টিকের ড্রাম বা মাটির মটকিতে পানি সংরক্ষণ করেন— এগুলো তিনদিনের বেশি রাখা যাবে না। রাখলেও ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে, না হলে এডিস মশা ডিম পাড়বে। এডিস মশা ভোরে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তাই তখন সাবধান থাকতে হবে।’
ম্যাসিভ আকারে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চলবে। হাসপাতাল রেডি করেছি, জরুরি ওষুধগুলো কিনে রাখছি, মিডিয়া ক্যাম্পেইন শুরু হচ্ছে। আমি নিজেও সরেজমিনে যাচ্ছি।- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ
তিনি বলেন, ‘জ্বর হলে এক-দুদিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে। না হলে কাছাকাছি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও পরীক্ষা করানো যাবে। জ্বর হলে প্রচুর পানি বা নানান ধরনের জুস পান করতে হবে। দুর্বলতা অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’
সিটি করপোরেশনগুলোকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘এখন খুব মনোযোগ দিতে হবে যাতে কোথাও প্লাস্টিক কনটেইনার বা নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে না থাকে। আমাদের মাসিক কর্মসূচি নেওয়া উচিত— যেমন, মে মাসে যদি সব কনটেইনার অপসারণ করতে পারি, তাহলে জুনে ডেঙ্গু কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আবার জুন মাসেও এটা চালু রাখতে পারলে জুলাইতে ফল পাওয়া যাবে। এভাবে সারা বছরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতিএ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শুরু করেছি, ওয়ার্ড ক্যাম্পেইন হচ্ছে, ইউথ ক্যাম্পেইন হচ্ছে। মশার ওষুধ ঠিকমতো ছিটানোর জন্য আগের চুক্তি বাদ দিয়ে আর্মির সঙ্গে চুক্তি করছি— তিনদিনের মধ্যে এটি সম্পন্ন হবে। ম্যাসিভ আকারে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চলবে। হাসপাতাল রেডি করেছি, জরুরি ওষুধগুলো কিনে রাখছি, মিডিয়া ক্যাম্পেইন শুরু হচ্ছে। আমি নিজেও সরেজমিনে যাচ্ছি।’
এসইউজে/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম