প্রবাস

‘প্রবাসীবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন’

‘প্রবাসীবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন’

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা আজ দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে সচল থাকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, গতি পায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সেইসব রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের মধ্যে একজন হলেন পোল্যান্ড প্রবাসী মো. ইমরান হোসেন। ২০২৩ সালে সরকারের কমার্শিয়ালি ইম্পরট্যান্ট পারসন (সিআইপি) মনোনীত হন তিনি। তার সাফল্যগাঁথা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি সিআইপি মনোনীত হওয়ার জন্য। এ অর্জনের অনুভূতি কেমন?

ইমরান হোসেন: ধন্যবাদ। আল্লাহর অশেষ রহমত ও আপনজনদের দোয়ায় আমি আজ এই সম্মানে ভূষিত হয়েছি। এটি কেবল আমার ব্যক্তিগত সাফল্য নয় বরং দেশের জন্য আমার দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি। বৈধপথে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পেরেছি—এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। সরকার আমার এ অবদানের মূল্যায়ন করে সিআইপি হিসেবে গেজেট প্রকাশ করেছে, এটা নিঃসন্দেহে গর্বের।

আরও পড়ুন: আমিরাতে তপ্ত রোদে কাজ, মেলে না ছুটি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে কাল্পনিক প্রচার একমাত্র শ্রমই পারে সফলতা বয়ে আনতে

জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও পারিবারিক পরিবেশ কেমন ছিল?

Advertisement

ইমরান হোসেন: আমি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সোবহান মোল্লা বাড়ির সন্তান। বাবা মরহুম হাছি মিয়া ছিলেন একজন সৎ, পরিশ্রমী মানুষ, আর মা সালমা বেগম সবসময় আমাদের সঠিক পথে চলতে উৎসাহ দিতেন। ছোটবেলা থেকেই পরিবারে নীতিনিষ্ঠা, পরিশ্রম আর মানুষের উপকারে আসার শিক্ষাই পেয়েছি। এই শিক্ষাগুলোই প্রবাসজীবনে আমাকে টিকিয়ে রেখেছে।

জাগো নিউজ: পোল্যান্ডে আসার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়েছিলেন?

ইমরান হোসেন: তখন বাংলাদেশে চাকরির সুযোগ সীমিত ছিল। নিজের ভবিষ্যৎ ও পরিবারের উন্নতির জন্য বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ছিল ছোটবেলা থেকেই। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমি ২০১০ সালের দিকে পোল্যান্ডে আসি। শুরুটা ছিল কঠিন। ভাষার সমস্যা, সংস্কৃতির পার্থক্য, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ—সব মিলিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া সহজ ছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। সময়ের সাথে নিজেকে তৈরি করেছি।

জাগো নিউজ: ব্যবসায় আসার শুরুটা কীভাবে?

Advertisement

ইমরান হোসেন: প্রথমে একটি চাকরি করতাম। সেখান থেকেই ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা পাই। কিছুদিন পর সঞ্চিত অর্থ দিয়ে নিজের একটি ছোট রেস্টুরেন্ট চালু করি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বড় হয়। বর্তমানে পোল্যান্ডে আমার কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে—রেস্টুরেন্ট, আমদানি-রপ্তানি এবং পরিষেবা খাত ভিত্তিক।

আরও পড়ুন রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের চোখে মে দিবস বাংলাদেশের অর্থনীতির সূর্য হয়ে জ্বলে যারা, উপেক্ষিত তারা দেশের ভাগ্য বদলালেও প্রবাসীদের ভাগ্য বদলায় না

জাগো নিউজ: বৈধপথে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন। এই পথটি কেন বেছে নিলেন?

ইমরান হোসেন: প্রথম থেকেই আমার নীতিগত অবস্থান ছিল স্বচ্ছতা ও আইনি পথ অবলম্বন করা। আমি মনে করি, প্রবাসীরা বৈধপথে অর্থ পাঠালে দেশের জন্য যেমন সুফল বয়ে আনে, তেমনি নিজেরাও সম্মান পান। অবৈধ পথে টাকা পাঠালে তা যেমন দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে, তেমনি প্রবাসীদের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি চাই প্রবাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হোক।

জাগো নিউজ: সিআইপি হিসেবে আপনি কী কী সুবিধা পাচ্ছেন?

ইমরান হোসেন: অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। আমি বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রবেশের অনুমতি পাব, সরকার কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী কমিটিতে সদস্য হওয়ার সুযোগ পাব। বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার, সরকারি হাসপাতালে অগ্রাধিকার চিকিৎসা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে বিশেষ সেবা এবং বিনিয়োগে বিদেশি বিনিয়োগকারীর মতো অধিকার পাব। এই সুবিধাগুলো আমাকে আরও দায়িত্ববান করে তুলেছে।

জাগো নিউজ: পরিবার ও বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

ইমরান হোসেন: সবার প্রতিক্রিয়াই ছিল দারুণ ইতিবাচক। আমার মা অনেক খুশি হয়েছেন। আমার এলাকার মানুষজনও গর্বিত হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায়, ফোনে অসংখ্য বার্তা পেয়েছি। এই ভালোবাসাই আমাকে ভবিষ্যতে দেশের জন্য আরও কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে।

জাগো নিউজ: অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামবাসীদের উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল এবার। এটা কীভাবে দেখছেন?

ইমরান হোসেন: অবশ্যই। এবারের সিআইপি তালিকায় বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্যাটাগরিতে অনেকেই চট্টগ্রামের। চট্টগ্রামবাসীরা বরাবরই পরিশ্রমী, উদ্যোগী ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধ। আমাদের অঞ্চল থেকে প্রবাসে অনেকেই সফল হয়েছেন, যা আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।

আরও পড়ুন ‘আইজ কামাই বেশি হইলে কাইল কাজে যাইবো না’ প্রবাসে ছুটিহীন মে দিবস প্রবাসীরা শুধু দিয়েই যাবে বিনিময়ে তাদের পাওয়ার কিছু নেই

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

ইমরান হোসেন: আমি চাই, একটি রেমিট্যান্সভিত্তিক সামাজিক উদ্যোগ গড়তে, যেটি প্রবাসীদের আইনি, বিনিয়োগ এবং পরামর্শমূলক সহায়তা দেবে। সেইসাথে আমি বাংলাদেশে প্রযুক্তি ও আবাসন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী। আমার লক্ষ্য হচ্ছে প্রবাসে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সম্পদ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো।

জাগো নিউজ: বর্তমান প্রবাসীদের জন্য কোনো বার্তা দিতে চান?

ইমরান হোসেন: অবশ্যই। আমি বলবো—পরিশ্রম করুন, ধৈর্য ধরুন, সততা ধরে রাখুন এবং সর্বোপরি বৈধপথে অর্থ পাঠান। প্রবাসজীবন কঠিন, কিন্তু সৎভাবে চললে সাফল্য আসবেই। দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকলে যে কেউ দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারে।

জাগো নিউজ: সরকারের প্রতি কোনো আহ্বান?

ইমরান হোসেন: আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবো—প্রবাসীদের জন্য এক স্টপ সার্ভিস চালু করা হোক, যেখানে বিনিয়োগ, ব্যাংকিং, নথিপত্র ও আইনি সহায়তা সহজে পাওয়া যাবে। পাশাপাশি দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। তাহলেই প্রবাসীরা আরও উৎসাহিত হবেন।

জাগো নিউজ: শেষ প্রশ্ন, আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?

ইমরান হোসেন: আমি চাই একটি স্বচ্ছ, উদার, আধুনিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ—যেখানে প্রবাসীরা গর্বের সাথে ফিরে আসতে পারবেন, বিনিয়োগ করতে পারবেন, সম্মান পাবেন। এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন।

পোল্যান্ড প্রবাসী ইমরান হোসেনের এই সাফল্য কেবল একজন প্রবাসীর অর্জন নয়—এটি গোটা প্রবাসী সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা। বৈধপথে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখলে সরকার তা সম্মান জানায়, এটাই তার অর্জনের প্রমাণ। তার মতো আরও অনেক প্রবাসী যদি সৎ ও স্বচ্ছ পথে চলেন, তবে বৈদেশিক রেমিট্যান্স দেশের উন্নয়নে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে।

এমআরএম/এএসএম