খেলাধুলা

ক্রীড়াঙ্গনে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে একগাদা সুপারিশ

ক্রীড়াঙ্গনে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে একগাদা সুপারিশ

* জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন সংশোধন* নারী দলের সাথে নারী ম্যানেজার বাধ্যতামূলক* বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি* বেতন-বোনাসে অসমতা দূর করা* শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী ক্রীড়া শিক্ষক নিয়োগ* বিদ্যালয়ভিত্তিক নারী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চালু* পার্বত্য অঞ্চলের কিশোরীদের প্রশিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা

Advertisement

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সেক্টর সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। যার একটি ছিল নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। গত বছর ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশের নারীদের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়ন এবং যুগযুগ ধরে চলে আসা নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসন এবং নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হককে প্রধান করে কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ১৫০ কার্যদিবসে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের সম-অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রতিবেদন তৈরি করতে বিভিন্ন পেশার নারীদের মতামতও নিয়েছে। প্রতিবেদনে আছে ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও। ক্রীড়াঙ্গনে নারী খেলোয়াড়, কোচ, সংগঠক এবং ক্রীড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যরা কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন, কি পদক্ষেপ নিলে নারী ক্রীড়াবিদরাও পুরুষ ক্রীড়াবিদদের মতো সমান অধিকার প্রতিষ্টা করতে পারেন- এ বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছে কমিশন।

জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক খেলোয়াড় ও বর্তমানে আইসিসি আম্পায়ার চম্পা চাকমা, হ্যান্ডবল ও ভলিবল কোচ ও রেফারি আখিরুন নেছা, আয়েশা জামান খুকী এবং হ্যান্ডবল কোচ ও রেফারি লাজুল কারীম কস্তরী ক্রীড়াঙ্গনের নারী প্রতিনিধি হিসেবে পরামর্শ সভায় উপস্থিত ছিলেন।

Advertisement

কমিশন মনে করেছে, ক্রীড়া কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণ সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদিও আমাদের দেশে সব ক্রীড়ায়ই পুরুষ ও নারীদের বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। এ ধরণের নানা সমস্যার বিষয়টি তুলে এনে তা সমাধানের সুপারিশ করেছে সরকারের কাছে। যে সুপারিশগুলোর কিছু অন্তর্বর্তীকলীন সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে, কিছু সুপারিশ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্যও উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিশন ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের অনেক সাফল্যের বিষয়টিও তাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে। জাতীয় নারী ফুটবল দলকে একুশে পদক প্রদান, নারী জাতীয় ক্রিকেট দলকে অদম্য নারী পুরস্কার প্রদানকে কমিশন অনুপ্রেরণাদায়ক হিসেবেই উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের দুইবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়, অন্যান্য বয়সভিত্তিক পর্যায়ের একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিষয়টিও ক্রীড়ায় নারীদের সাফল্যের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নারীদের অন্যান্য খেলার দলগত ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের কিছু সাফল্যের কথাও।

বেতন বৈষম্য, বেতন কাঠামোহীনতা, বেতন প্রদানে অনিয়মের বিষটিও বাদ পড়েনি কমিশনের প্রতিবেদনে। নারী ফুটবলারদের দ্বিতীয়বার সাফ শিরোপা জয়ের আগে তিনমাস বেতন না পাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছে কমিশন। কমিশনের সদস্যরা জেনেছেন- সাফল্য আনার পরও নারী ক্রীড়াবিদরা বেতন বৈষম্যের শিকার।

ক্লাব-ফুটবলে নারী-খেলোয়াড়রা ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা আয় করেন। সেখানে পুরুষ ফুটবলারদের আয় ৫০-৬০ লাখ টাকা। নারী ক্রীড়াবিদদের অর্জনকে যথাযথ মূল্যায়ন এবং প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয় না উল্লেখ করে কিছু উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছেন নারী ক্রীড়াবিদদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকার কথাও।

Advertisement

নারীদের জন্য পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, আর্থিক অনিশ্চয়তা, সুযোগ-সুবিধা কম পাওয়া, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা, পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়া, ক্রিকেটের প্রতি বেশি মনোযোগের কারণে অন্য খেলায় আর্থিক বরাদ্দ ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যথাযথ না থাকা, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোকে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ না দেওয়া, ক্রীড়ার সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া, ফেডারেশনগুলোর কার্যনির্বাহী কমিটিতে ৩০ শতাংশ নারী রাখার গাইডলাইন না মানা, নারী ক্রীড়া দলের সাথে পুরুষ ম্যনেজার ও ফিজিও পাঠানো এবং রাজনৈতিক নিয়োগসহ আরো অনেক সমসার কথা উল্লেখ করে এসব সমস্যা সমাধান করে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশমালা তৈরি করে জমা দিয়েছে এই কমিশন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে করণীয় কাজগুলো হিসেবে কমিশনের উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হচ্ছে- সকল পর্যায়ের ক্রীড়া কর্মকান্ড ও কাঠামোতে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন ২০১৮ সংশোধন করা, জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়া পরিষদ ও বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রীড়া সংস্থায় নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধির বিধান প্রনয়ন করা, পার্বত্য এলাকা ও অন্যান্য প্রান্তিক এলাকার কিশোরীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার লক্ষ্যে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার বিধান রেখে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) আইন ২০২০ সংশোধন করা।

ক্রীড়া ফেডারেশন ও সংস্থায় রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করতে নীতিমালা তৈরি করা, জাতীয় ক্রীড়ানীতি-২০২৩ এর খসড়া অনুমোদন করে বাস্তবায়ন করা, মহিলা ক্রীড়া সংস্থাকে জাতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্ট পরিচালনা ও আয়োজনের ক্ষমতা দিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা, কর্মক্ষেত্র নারীবান্ধব করতে ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য জেন্ডার নীতিমালা প্রণয়ন করা।

নারী ও পুরষ খেলোয়াড়দের মধ্যকার বেতনবৈষম্য দূর করে খেলোয়াড়দের জীবনমানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় বেতনকাঠামো তৈরি করা, খেলোয়াড় নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) এবং অন্যান্য ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের কাঠামোতে ৩০ ভাগ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, অ্যাডহক কমিটিগুলোকে ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা।

জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও জেলা পর্যায়ের ফেডারেশনের সাথে জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সমন্বয় বৃদ্ধি করা, ব্যক্তিগত ইভেন্টের ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে নারী-খেলোয়াড়দের মাসিক ভাতা প্রদান এবং তাদের পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করা, নারীদের বিনামূল্যে খেলার সরঞ্জাম ও পোশাক প্রদান করা, সকল পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি বন্ধে অভিযোগ কমিটি গঠন, সন্ত্রাসের মাধ্যমে নারীদের খেলা বন্ধ করার প্রচেষ্টা কঠোরভাবে প্রতিহত করতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক নারী-ক্রীড়া টুর্নামেন্ট বৃদ্ধি করা ও এক্ষেত্রে সরকারী পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা, আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক এলাকার নারীদের জন্য বিশেষ ক্রীড়া প্রতিযেগিতা আয়োজন করা, বিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়েশিশুদের জন্য ক্রীড়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং গণমাধ্যমে সফল নারী-ক্রীড়াবিদদের গল্প তুলে ধরার ব্যবস্থা করা।

পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে করণীয় হিসেবে কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলোর উল্লেখযোগ্য হলো-জেলা পর্যায়ে, বিশেষ করে পার্বত্য ও অন্যান্য প্রন্তিক এলাকায় নারীবান্ধব ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ, নারী-খেলোয়াড়দের জন্য খাওয়াখরচসহ নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করতে এই খাতে অর্থবরাদ্দ বৃদ্ধি করা, বিকেএসপিতে নারীদের জন্য আসন বরাদ্দ এবং নারী-কোচ নিয়োগ বৃদ্ধি করা, নারীদের জন্য বিশেষায়িত ক্রীড়া ক্লাব তৈরি করা, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী-ক্রীড়াশিক্ষক নিয়োগ, নারী ক্রীড়া দলের সাথে নারী-ম্যানেজার ও ফিজিও দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, ক্রীড়ার অবকাঠামোতে নারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে সফল নারী ক্রীড়াবিদদের সম্পর্কে লেখা অন্তর্ভূক্ত করা।

বিভিন্ন কমিশনের প্রতিবেদনগুলো নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করছে। যেসব বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্টিত হবে সেই সব সংস্কার করবে সংস্কার। কিছু সংস্কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই করার সুপারিশ করা হয়েছে। কিছু সংস্কারের কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সময়ে কার্যকরের কথা বলা হয়েছে। এখন দেখার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার পর কোন বিষয়গুলো সংস্কারের জন্য ঐত্যমত্য হয়। এরই মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল পরিস্কার বলেছে নারী সংস্কারের প্রস্তাবনা তারা ‘এ’ টু ‘জেড’ প্রত্যাখান করছে।

আরআই/আইএইচএস/