১৪ বছর আগে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে যোগ দেন আবিদুর রহমান (ছদ্মনাম)। দীর্ঘ এই সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশের একাধিক ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মোহাম্মদপুর থানায় দায়িত্বরত। তার ১৪ বছরের চাকরি জীবনে কখনো কর্মস্থলে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে পারেননি।
Advertisement
বছরে যে সরকারি ছুটি মেলে, সেটাও ভালোভাবে কাটানোর সুযোগ পান না। ৫ আগস্টের পর বদলিসূত্রে ঢাকায়। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুলিশের ডিউটির শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আট ঘণ্টা ডিউটির জায়গায় কখনো কখনো ১০, ১২ এমনকি ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত টানা ডিউটি করতে হয়। পরিস্থিতি যখন খারাপ থাকে তখন ডিউটির সময় বেড়ে যায়। এমনও হয়েছে সারারাত ডিউটি করে আবার সকাল ১০-১১টা থেকে ডিউটি করা লাগছে।’
২০১১ সালে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন ডিএমপির মিরপুর মডেল থানার জাকির হোসেন (ছদ্মনাম)। এ পর্যন্ত পুলিশের পাঁচটি ইউনিটে কাজ করেছেন তিনি। কয়েক মাস হলো ডিএমপিতে যোগ দিয়েছেন। গত ১৪ বছরে সাপ্তাহিক ছুটিও মেলেনি তার। বছরে দু-একবার ছুটির আবেদন করলে কখনো মেলে, আবার কখনো মেলে না। এটা নিয়েই চাকরি করে যাচ্ছেন তিনি।
থানায় আমাদের ডিউটি করতে হয় কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা করে। সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি, ঈদের ছুটি এবং বাকি সরকারি ছুটিতে সবাই ছুটি ভোগ করেন। কিন্তু আমরা পুলিশ এসব ছুটি ভোগ করতে পারি না। অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি।- বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল হাসান তালুকদার
Advertisement
তিনি বলেন, ‘মানুষ চাকরি করে পরিবারকে আর্থিক ও মানসিকভাবে স্বস্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা কি সেটা পারি? পুরো বছরে মাত্র কয়েকদিন ছুটি পাই। মাঝে-মধ্যে যদি কোনো স্বজনের মৃত্যু সংবাদ আসে, তখন আবেদন করলে দু-একদিনের জন্য ছুটি পাই। সেটাও বার্ষিক ছুটি থেকে কেটে নেওয়া হয়। আবার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হলে বা বড় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে তখন সব ধরনের ছুটি বন্ধ। মোটকথা আমাদের যখন ছুটি দরকার হয়, তখন ছুটি মেলে না।’
আরও পড়ুনঝুঁকিভাতাসহ অনেক দাবি পুলিশের, কমছে ভিআইপি প্রটোকলপুলিশের এসিআর দেওয়া ও কাজের মূল্যায়নের দায়িত্ব চান ডিসিরাপুলিশের জন্য ১৭২ কোটি টাকায় কেনা হচ্ছে ২০০ জিপঢাকা শহর নিরাপদ রাখতে দিনরাত কাজ করছে পুলিশনাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুর থানার একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২০ সালে পুলিশ বাহিনীতে এসআই পদে যোগ দেই। পাঁচ বছরে ডিএমপিতে চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু ৫ আগস্টের পর হঠাৎই মোহাম্মদপুর থানায় পোস্টিং হয়। এরপর এখানে এসে দেখি খুবই খারাপ অবস্থা। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা একের পর অপরাধ ঘটছিল। তখন ডিউটির কোনো শেষ ছিল না। এমনও হয়েছে মাত্র ঘুমিয়েছি কিছুক্ষণ পর ঊর্ধ্বতন স্যার ফোন করে আবারও ডিউটি করতে বলেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নয়, অন্য সময়েও পুলিশের শেষ ডিউটি বলে কিছু থাকে না। এক প্রকার অভ্যস্ত হয়ে গেছি এবং এটিই বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিতে হয়েছে।’
ওপরের তিন পুলিশ সদস্যের মতো ডিএমপি ও থানায় কর্মরত অধিকাংশ পুলিশ সদস্যের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সময়ের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। ১২ ঘণ্টা, ১৬ ঘণ্টা এমনকি ১৮ ঘণ্টাও ডিউটি করতে হয় প্রতিদিন। সাপ্তাহিক ছুটি বলতেও কিছু নেই। দীর্ঘদিন এভাবে ডিউটি করতে গিয়ে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ফলে পুলিশের কাছে ভালো আচরণ আশা করাটাও দায়।
Advertisement
পুলিশ সংস্কার কমিশনের মিটিংয়ে আমাদের মতামত জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- পুলিশ সদস্যরা ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করেন, এ বিষয়টি যেন বর্তমান সরকার আমলে নেয়। অতিরিক্ত ডিউটির জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া হোক।- বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আনিসুজ্জামান
নাম প্রকাশ না করে নিজের ভেতরে জমে থাকা কষ্টের এই কথাগুলো বললেন শাহবাগ থানার একজন এসআই। কষ্ট আর হতাশা কেবল তার একার নয়, কনস্টেবল, ইন্সপেক্টর, এএসপি ও এসপি পদমর্যাদার কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলেও একই চিত্র পাওয়া যায়।
জানা যায়, ইমার্জেন্সি সার্ভিস হিসেবে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনেই সাপ্তাহিক ছুটির কোনো বিধান রাখা হয়নি। আইনে বলা হয়েছে- ‘পুলিশ সদস্যরা সর্বদা দায়িত্বরত (অন ডিউটি) হিসেবে বিবেচিত হবেন।’ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, জনবল ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে পুলিশের এই কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব, যেন কোনোভাবেই একজন পুলিশ সদস্যের প্রতিদিনের ডিউটি ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার বেশি না হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশে কর্মরত একটি বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) জানান, কনস্টেবল কিংবা এডিসি-ডিসি বলে কোনো কথা নেই। পুলিশ আইন ও সংবিধান অনুযায়ী ইমার্জেন্সি সার্ভিস হিসেবে যখন যার প্রয়োজন, তার ডিউটিতে থাকা বাধ্যতামূলক। এখানে মানবিকতা কিংবা অমানবিকতা বলে কোনো শব্দ নেই। পুলিশের আইন অনুযায়ী, পুলিশ সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা অন ডিউটিতে থাকবেন। আইনেই পুলিশ বাহিনীকে ইমার্জেন্সি সার্ভিস হিসেবে ঘোষণা করা আছে।
তিনি বলেন, ‘পুলিশের ইউনিট ভেদে ডিউটির ধরনও ভিন্ন হয়। যেমন- যেসব পুলিশ সদস্য অফিসিয়াল দায়িত্বে থাকেন, তারা সব সময় না পারলেও প্রায়ই সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করার সুযোগ পান। কিন্তু থানায় কিংবা কিছু ইউনিটে এ সুযোগ নেই। ডিউটি অফিসার নামে থানায় এসআই পদমর্যাদার একজন দায়িত্ব পালন করেন। দুই শিফটে দুজনকে ১২ ঘণ্টা করে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। তিনজন হলে আট ঘণ্টা করে ডিউটি হতো। কিন্তু সেই জনবল আমাদের নেই।’
জেলা পুলিশে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এসআই জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুলিশে ব্রিটিশ আইন এখনো রয়েছে। সরকার আইন সংশোধন করে অথচ পুলিশের আইনে হাত দেয় না। চাইলে ৮ ঘণ্টা ডিউটি চালু করা সম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিদিন দুজনের ডিউটি করছে একজন পুলিশ। বেতন পাচ্ছে একজনের। ডিউটি হিসেবে পুলিশের বেতন হওয়ার কথা ডাবল।’
মেন্টাল স্ট্রেসে (মানসিক চাপ) শ্বাসকষ্ট, আইএলডি (ফুসফুসের রোগ), ডায়াবেটিস বেড়ে যায়, কিডনিজনিত সমস্যাসহ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।- রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক (ডিআইজি) সরদার নূরুল আমিন
তিনি বলেন, ‘সরকারের অন্য দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ডিউটি শেষে তাদের পরিবারের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু একমাত্র পুলিশ সদস্যরা গাদাগাদি করে ব্যারাকে থাকেন। অতিরিক্ত ডিউটির কারণে পরিবারের সঙ্গে বা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে পুলিশ সদস্যরা যোগ দিতে পারে না। এভাবে ধীরে ধীরে তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হচ্ছে।’
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী অন্য সরকারি কর্মচারীর মতো পুলিশেরও বছরে ৩৩ দিন করে অর্জিত ছুটি জমা হয়। পিআরএল বা অবসরে যাওয়ার সময় অন্য সরকারি কর্মচারীদের ন্যূনতম এক বছরের ছুটি জমা থাকতে হয়। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অবসর নেওয়ার আগে প্রায় সবারই অর্জিত ছুটি এক বছরের চেয়ে অনেক বেশি জমা থাকে। কিন্তু পিআরএল সুবিধা পান ওই এক বছরই।
পুলিশ সদস্যরা মনে করেন, জমা থাকা অতিরিক্ত ছুটির বিনিময়ে যদি আর্থিক সুবিধা দেওয়া হতো, তাহলে ছুটি নিয়ে এত কথা উঠতো না। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্যও পুলিশ সদস্যদের বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না। সেজন্যেও ওভারটাইমসহ সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো উচিত।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসবির ইন্সপেক্টর কামরুল হাসান তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘থানায় আমাদের ডিউটি করতে হয় কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা করে। সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি, ঈদের ছুটি এবং বাকি সরকারি ছুটিতে সবাই ছুটি ভোগ করেন। কিন্তু আমরা পুলিশ সদস্যরা এসব ছুটি ভোগ করতে পারি না। অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি। সরকারি ছুটির সময় পুলিশকে ছুটি না দিলেও অন্তত যেন প্রণোদনা দেওয়া হয় সরকারের অন্য সেক্টরের মতো।’
বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার কমিশনের মিটিংয়ে আমাদের মতামত জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- পুলিশ সদস্যরা ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করে, এ বিষয়টি যেন বর্তমান সরকার আমলে নেয়। অতিরিক্ত ডিউটির জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া হোক। এ প্রস্তাবটি সংস্কার কমিশন যাচাই-বাছাই করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কাছে দিয়েছে।’
অতিরিক্ত ডিউটির কারণে বিভিন্ন রোগশোকে আক্রান্ত হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক (ডিআইজি) সরদার নূরুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, `মেন্টাল স্ট্রেস (মানসিক চাপ), শ্বাসকষ্ট, আইএলডি (ফুসফুসের রোগ), ডায়াবেটিস বেড়ে যায়, কিডনিজনিত সমস্যাসহ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।’
টিটি/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম