ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলের ক্যান্টিনে বড়দের সঙ্গে কাজ করে অনেক শিশু-কিশোর। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা। তবে বেতন পায় অনেক কম। তাদের অভিযোগ, একই ক্যান্টিনে বড়দের সঙ্গে তারা সমান কাজ করলেও বেতন অনেক কম দেওয়া হয়।
Advertisement
আইনত শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও বাধ্য হয়ে হলগুলোতে কাজ করতে হয় শিশু-কিশোরদের। চাঁদপুরের দরিদ্র পরিবারের কিশোর সাকিব (ছদ্মনাম)। বাবার কাছে ৭০০ টাকা পরীক্ষার ফি ও ২০০ টাকা পকেট খরচ চাইলে বাবা দিতে পারেননি। ক্ষোভ ও কষ্ট নিয়ে সাকিব চলে আসে ঢাকায়। কাজ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্যসেন হলের ক্যান্টিনে। এখানে মাসিক সাত হাজার ৫০০ টাকা বেতনে কাজ করে, অর্থাৎ দিনে তার মজুরি ২৫০ টাকা। অথচ একই ক্যান্টিনে কাজ করেন শফিক (ছদ্মনাম), প্রায় ৪০ বছর বয়সী শফিক বেতন পান ১৫ হাজার টাকা।
সাকিব অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের কাজ প্রায় একই রকম। আমরা সমান সমান কাজ করি। কিন্তু আমি বয়সে ছোট বলে বেতন কম দেয়। সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ডিউটি করি। মাঝে চার-পাঁচ ঘণ্টা কাজ না থাকলেও পুরো সময়টাই ক্যান্টিনে থাকতে হয়। তাই এই বেতনটা আমার কাছে খুবই কম মনে হয়।’
এই বেতন বৈষম্য নিয়ে জানতে চাইলে ক্যান্টিন মালিক শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘ছোটদের দিয়ে তো ভারী কাজ করানো যায় না। তারা পানি এনে দেয়, টেবিল মুছে দেয়, তরকারির ঝোল এনে দেয়। আর বড়রা ভারী কাজ করেন। তাই তাদের বেতন বেশি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোটদের বেতনও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।’
Advertisement
শুধু সূর্যসেন হলে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলেই একই অবস্থা। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ক্যান্টিনে মোট ১৫ জন কর্মী রয়েছে, যার মধ্যে ছয়জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাদের কেউ দিনে মজুরি পায় ২০০ টাকা, কেউ ২৫০ টাকা, কেউবা ৩০০ টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে বড়দের মজুরি শুরু ৩০০ টাকা থেকে, কেউ ৭০০ টাকা পর্যন্ত পান।
আরও পড়ুনদিনে স্কুল, রাতে সৈকতে কাজ করে জীবন কাটে ইউসুফদের শ্রমিকদের জীবনচক্র আটকে আছে চা বাগানের গণ্ডিতে বিশ্ব শ্রমিক দিবস ও শিশুশ্রম: প্রেক্ষিত বাংলাদেশহাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ক্যান্টিন মালিক ইউসূফ আলী বলেন, ‘ছোটরা সাধারণত ছোট কাজ করে। পানি দেওয়া, টেবিল মোছা, এসবই তাদের দায়িত্ব। বড়রা খাবার পরিবেশন করেন, কাউন্টারে বসেন, রান্নায়ও সাহায্য করেন। তাই তাদের বেতন একটু বেশি হয়।’
১৭ বছর বয়সী শাহাদাত (ছদ্মনাম), ৯ দিন হলো কাজ করছে মুহসীন হলের ক্যান্টিনে। শাহাদাত জানায়, সে বার্বুচির সঙ্গে থাকে। দিনে ২৫০ টাকা দেওয়ার কথা। তবে অসুস্থতার কারণে শেষ দুদিন কাজ করতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে এই বৈষম্য আরও বেশি চোখে পড়ে। ১২ বছর বয়সী শাহেদ (ছদ্মনাম) এই হলের ক্যান্টিনে কাজ করছে। তার মাসিক বেতন মাত্র ৫ হাজার টাকা, যেখানে অন্যদের বেতন সাত হাজার টাকা বা এর বেশি।
Advertisement
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যান্টিন মালিক মোহাম্মদ তুহিন বলেন, ‘শাহেদ খুবই ছোট ছেলে। কাজের সময় ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। খেলাধুলা করে বেড়ায়। ওর মামা আমাদের ক্যান্টিনেই কাজ করেন। তার কারণেই ওকে রাখা হয়েছে। না হলে এত ছোট কাউকে রাখা হতো না।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ক্যান্টিনগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যেহেতু এটি ইনফরমাল অ্যারেঞ্জমেন্ট, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্তক্ষেপ থাকে না। তবে বেতন বৈষম্য ঠিক কতটা এবং কোনো ধরনের শোষণ হচ্ছে কি না আমরা তা খতিয়ে দেখবো।’
বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত-২০১৮) অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কাউকে শ্রমে নিযুক্ত করা বেআইনি। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা মানা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও নিযুক্ত করা হচ্ছে।
এফএআর/ইএ/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম