দখল-দূষণে প্রমত্তা ‘চিত্রা’ এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীতে কাটা হয়েছে অসংখ্য পুকুর। দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। একাধিকবার এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণের উদ্যোগ নিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মাঝে।
Advertisement
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের পানি সম্পদ উপদেষ্টার নির্দেশে গত বছরের নভেম্বরে চিত্রা নদীর দুই পাড়ে অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়। একই মাসে অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করণের কাজ শেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকাশ করা হয় ৯৬ জন দখলদারের নামের তালিকা। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর দখলদার তালিকা প্রকাশ করে তাদের নিজ নিজ স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয় পাউবো।
পাউবোর বিজ্ঞপ্তিতে দখলদারদের অভিযোগ, বক্তব্য ও আপত্তি উত্থাপনের জন্য ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর দীর্ঘ ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও অবৈধ স্থাপনা সরানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি।
কালীগঞ্জ পৌরসভাসহ উপজেলায় ৬২টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া কোটচাঁদপুর উপজেলার ধোপাবিলা, লক্ষ্মীপুর, সদর উপজেলার বংকিরা গ্রামের একটি অংশে আরও ৩৪টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে পাউবো। এসব স্থাপনার মালিকদের নোটিশ দিয়ে জানানোর কাজও শেষ হয়েছে।
Advertisement
সরেজমিনে দেখা গেছে, চিত্রা নদীর বুকে গজিয়ে ওঠা এসব অবৈধ স্থাপনা, পুকুর ও বাঁধ টিকে আছে বহাল তবিয়তে। কালীগঞ্জের ফয়লা হাসপাতালের সামনের অংশে নদীর পাড়ে চলছে বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ। কালীগঞ্জ শহরের নতুন ব্রিজ এলাকায় নদীর পাড় ঘেঁষে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে একাধিক স্থাপনা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে এসব স্থাপনা টিকে আছে। রাজনৈতিক পালাবদল হলেও প্রভাবশালীরা রাতারাতি ভোল পাল্টে নদীর জায়গা দখল বজায় রেখেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, আগে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে নদীর জায়গা দখল করে দোকান, পাট বানিয়েছিল দখলদাররা। ৫ আগস্টের পর নদী পাড়ের বাসিন্দারা নতুন আশার আলো দেখেছিল। কিন্তু দখলদার পাল্টেছে, স্থাপনা আগের জায়গাতে আছে। মালিক বদলেছে, কিন্তু নদীতে গড়ে তোলা পুকুর উচ্ছেদ হয়নি।
কোটচাঁদপুর উপজেলার দোড়া গ্রামের চিত্রা পাড়ের কয়েকজন কৃষক বলেন, নদীতে পানি নেই। প্রভাবশালীরা দখল করে নদীর মাটি সমান করে ধান লাগিয়েছে। কেউ কেউ পুকুর কেটে মাছ চাষ করে। সাধারণ মানুষ নদীতে মাছ ধরতেও ভয় পায়। পুকুরের মালিকরা রাজনৈতিক প্রভাবশালী।
Advertisement
কালীগঞ্জ পৌর শহরের ফয়লা এলাকার কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্ষাকাল ছাড়া নদীতে পানি থাকে না। নদীর কয়েকটি পয়েন্টে নতুন করে শহরের ময়লা ফেলা হচ্ছে। ময়লা ফেলতে ফেলতে কোনো একদিন হুট করেই স্থাপনা তৈরি হয়ে যাবে। এ যাবত কালে নদী তীরে গড়ে তোলা স্থাপনা নির্মাণে এমন কৌশলই দেখে আসছি।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জেলার ওপর দিয়ে ১২টি ছোট বড় নদ-নদী বয়ে গেছে। এরমধ্যে ঝিনাইদহ অংশে রয়েছে চিত্রা নদীর দৈর্ঘ্য ৫৭ কিলোমিটার। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৭১ কিলোমিটার।
জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার দোড়া, কালীগঞ্জ উপজেলা শহর হয়ে তত্বিপুর ও মালিয়াট ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত চিত্রা নদী যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলা হয়ে নড়াইলে গিয়ে মিশেছে। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে এ নদীর উৎপত্তিস্থল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস বলছে, চিত্রা নদীর ঝিনাইদহ জেলা অংশের বেশির ভাগ জায়গায় বিগত ১৬ বছরে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছিল প্রভাবশালীরা। নদীতে বাঁধ দিয়ে শত শত পুকুর তৈরি করেছিল একটি চক্র। নদীর বুকে বাণিজ্যিক মাছ চাষের লক্ষ্যে এসব পুকুর তৈরি করা হয়। নদীর মাটি কেটে পাড় বেঁধে তৈরি করা হয় পুকুর।
সদর উপজেলার গান্না, জিয়ানগর, হাজরা, লক্ষ্মীপুর, মোহাম্মদপুর ও গোবিন্দপুর এলাকায় দেখা গেছে, নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে পুকুর বানিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাছ চাষ করা হচ্ছে। তবে এসব পুকুরের মালিক কে বা কারা, তা নিয়ে স্থানীয়রা মুখ খুলতে নারাজ।
এছাড়া কোটচাঁদপুর উপজেলার ঘাঘা, ইকড়া, কালীগঞ্জ পৌর শহরের পুরাতন বাজার, বলিদাপাড়া, হেলাই, ফয়লা, নিমতলা ও নদীপাড়া এলাকায় দখলদারদের কবজায় চিত্রা নদী। এমনকি কালীগঞ্জ উপজেলার সিংদহ গ্রামে নদীর মধ্যে ৮টি পুকুর কেটে মাছ চাষ করছেন প্রভাবশালীরা। ফলে এক সময়ের প্রমত্তা চিত্রা তার যৌবন হারিয়ে এখন মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে। দখলের ফলে ভরাট হয়ে গেছে চিত্রার কোনো কোনো অংশ। ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা চরমে পৌছায়।
চিত্রা নদীতে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ নিয়ে ঝিনাইদহের মানবাধিকার কর্মী অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু জানান, জেলার নদ-নদীগগুলো বাঁচাতে হবে। দখলবাজ বা অন্যায়কারীদের কোনো রাজনৈতিক দল হয় না। তারা সুবিধাবাদী। এ শ্রেণির মানুষ সমাজ, দেশ ও মানুষের কল্যাণের চিন্তা করে না। সবাই সোচ্চার হলে দখলদারদের রুখে দেওয়া সম্ভব।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস জানান, প্রতিটি জেলায় একটি করে নদী দূষণ ও দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। সেই হিসেবে জেলায় চিত্রা নদীকে বেছে নেওয়া হয়েছে। চিত্রা নদীর কোটচাঁদপুর ও কালীগঞ্জ অংশে ৯৬টি অবৈধ স্থাপনা শনাক্তের কাজ শেষ হয়েছে।
তিনি বলেন, স্থাপনাগুলো চিহ্নিত করার পরে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের ওয়েবসাইটেও নোটিশ করা আছে। যদি কারও কোনো অভিযোগ, আপত্তি কিংবা বক্তব্য থাকে তারা যেন আমাদের কাছে সেটা জানাতে পারে। এ পর্যন্ত আমরা ৩টি আপত্তি পেয়েছি। সেগুলো ভূমি অফিস ও এসিল্যান্ড অফিসে শুনানি হবে। আশা করছি আগামী সপ্তাহের মধ্যে আমরা অবৈধ স্থাপনা সরানোর কাজ শুরু করতে পারব।
শাহজাহান নবীন/আরএইচ/জেআইএম