• গ্যারেজ ও রাস্তায় পড়ে থাকছে প্যাডেলচালিত রিকশা, চালানোর চালক নেই• যাত্রীর অভাবে কাটাচ্ছেন অলস সময়, আয় নেমেছে অর্ধেকে• ব্যাটারিচালিত রিকশার চেয়ে চালকের সংখ্যা বেশি, প্রতিদিন বাড়ছে চাহিদা • পুরোনো রিকশার ফ্রেম ও চেসিসের সঙ্গে মোটর, ব্যাটারি বসিয়ে অটো করা হচ্ছে• কোনো কোনো রিকশার কাঠের কাঠামো পাল্টে স্টিলের করা হচ্ছে
Advertisement
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ের উত্তর বেগুনবাড়ী এলাকায় একটি রিকশা গ্যারেজের পাশে ফাঁকা রাস্তায় বসে আছেন রিকশাচালক আসাদুজ্জামান। দিনচুক্তিতে ভাড়া নেওয়া প্যাডেলচালিত রিকশার জমার টাকা দিতে এসেছেন তিনি। তবে ওইদিন তার আয় ভালো হয়নি। মাত্র ৪৫০ টাকা ভাড়া পেয়ে পরিবারের জন্য চাল কিনেছেন। যে কারণে জমার টাকা দিতে চান না তিনি। আর সে অনুমতির জন্য মালিকের অপেক্ষায় আসাদকে বসিয়ে রেখেছেন গ্যারেজের ব্যবস্থাপক।
প্যাডেলচালিত রিকশার বর্তমান অবস্থার খোঁজ নিতে গিয়ে আসাদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের।
১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকায় রিকশা চালান আসাদ। তিন মেয়ের মধ্যে দুজনকে বিয়ে দিয়েছেন। আরও এক ছেলে, স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন রিকশা চালানোর টাকায়। তবে তার আক্ষেপ, বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন প্যাডেলচালিত রিকশাচালকরা। ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া পাচ্ছেন না তিনি।
Advertisement
আসাদের ভাষ্যমতে, বাসস্ট্যান্ডে এসে এখন মানুষ শুধু রিকশার নিচে ব্যাটারি আছে কি না দেখেন। ব্যাটারি না থাকলে যেতে চান না। দু-একটা ছোট খ্যাপ হয়। বেশিরভাগ সময় রিকশাচালকদের বসে বসে কাটে।
ভাড়া হচ্ছে না তাহলে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদ বলেন, ‘এই রিকশার (প্যাডেল) দৈনিক জমা ১০০ টাকা, ব্যাটারিরটা ৪০০ টাকা। এত রিস্ক নিতে পারি না, অনেক বয়স হয়েছে। তারপর তো রিকশা ছিনতাই হয়, চুরি হয়। তখন কী হবে? আবার দেখেন, ব্যাটারির রিকশা ঠুসঠাস উল্টে যায়, এই বয়সে একটা হাত-পা ভাঙলে পরিবার শেষ। এজন্য চালাই না।’
আরও পড়ুন অটোরিকশার ডিজাইন করছে বুয়েট, প্রশিক্ষণে মিলবে লাইসেন্স দৌরাত্ম্য রুখতে অটোরিকশা নীতিমালা তৈরির আহ্বান এক ব্যক্তি একাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক হতে পারবেন নাতাহলে এখন সংসারের কী হাল এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদ বলেন, ‘সারাজীবন ইনকাম করে ছেলে-মেয়েদের খাওয়ালেও শেষ কয়েক মাস খুব খারাপ আছি। একবেলা চুলা জ্বলে তো, আরেক বেলা জ্বলে না। ধারদেনা করে অবস্থা খুব খারাপ। গ্যারেজ মালিককেও প্রতিদিন জমার টাকা দিতে পারি না। অনেক টাকা বাকি হয়ে গেছে।’
শুধু আসাদ নন, ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বাড়ায় প্যাডেলচালিত রিকশাচালকদের এমন করুণ দুর্দশার কথা জানা গেছে আরও বেশ কয়েকজন চালক ও গ্যারেজের মালিক-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে।
Advertisement
চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের স্বল্পতার সুযোগে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঢাকাসহ সারাদেশ ছেয়ে গেছে। এসব কারণে পেশা পাল্টাচ্ছেন প্যাডেলচালিত রিকশাচালক ও ওইসব রিকশার গ্যারেজ মালিক-কর্মচারীরা।
‘এই গ্যারেজের ৬০টি রিকশার মধ্যে প্রায় ২০টি অটো করা হয়েছে। পুরোনো রিকশার ফ্রেম ও চেসিসের সঙ্গে মোটর, ব্যাটারি ও রিং লাগিয়ে নতুন করে অটো করা হয়। কোনো কোনো রিকশার কাঠের বডিও পরিবর্তন করে স্টিলের করা হয়। সব মিলিয়ে খরচ হয় ৫৬ হাজার টাকা।’- মিস্ত্রি আমিরুল ইসলাম
উত্তর বেগুনবাড়ী বিটাক অফিসের পাশের রাস্তায় অহিদের গ্যারেজে রিকশাচালক আসাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সেখানে নজরুল ইসলাম, আতিকুল ও মাসুদ মিয়ার বেশ পুরোনো আরও তিনটি গ্যারেজ আছে। এগুলোতে প্রায় ২৫০টি প্যাডেলচালিত রিকশা প্রতিদিন ভাড়ায় যেত। কিন্তু এখন প্রতিদিন ৫০টি রিকশাও ভাড়া হচ্ছে না। কারণ বেশিরভাগ চালক এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাচ্ছেন।
সরেজমিনেও দেখা গেলো, বিটাকের পাশের রাস্তাসহ উত্তর বেগুনবাড়ী এলাকায় সারি সারি রিকশা প্রায় অকেজো পড়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে রাস্তার ওপরে রিকশার ভাগাড়।
এরমধ্যে আবার শতাধিক প্যাডেলচালিত রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়ে ইঞ্জিনচালিত (অটো) করা হয়েছে গত কয়েক মাসে। সেগুলোর চাহিদা আবার তুঙ্গে। তবে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ ওইসব ইঞ্জিনচালিত রিকশা আসাদের মতো যারা চালাতে পারছেন না, তারা বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করছেন নয়তো একবেলা-আধাবেলা খেয়ে বাঁচছেন।
‘যেখানে ৫০ টাকা ভাড়া, সেখানে অটোরিকশা ৩০ টাকায় হু হু করে চলে যায়। এদিক সেদিক তাকায় না, মারে দৌড়। আমরা চেয়ে থাকি। আগে যেখানে দিনে ৮০০ থেকে হাজার টাকা ইনকাম ছিল, সেটা এখন অর্ধেকে নেমেছে।’ -রিকশাচালক বিল্লাল শেখ
আরেক রিকশাচালক বিল্লাল শেখ বলেন, ‘যেখানে ৫০ টাকা ভাড়া, সেখানে অটোরিকশা ৩০ টাকায় হু হু করে চলে যায়। এদিক সেদিক তাকায় না, মারে দৌড়। আমরা চেয়ে থাকি। আগে যেখানে দিনে ৮০০ থেকে হাজার টাকা ইনকাম ছিল, সেটা এখন অর্ধেকে নেমেছে।’
আরও পড়ুন অটোরিকশা চালকদের হামলায় ৩ ট্রাফিক পুলিশ হাসপাতালে চার মাসে ১ লাখ ৩৯ হাজার মামলা, জরিমানা প্রায় ৫০ কোটি টাকা লাইসেন্স ও ট্যাক্সের আওতায় আসছে ব্যাটারিচালিত রিকশাঅহিদের গ্যারেজের ম্যানেজার ও মিস্ত্রি আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যারেজের ব্যাটারি রিকশা ভাড়া নেওয়ার জন্য দ্বিগুণ চালক আছেন। অনেকে রিকশা পাচ্ছেন না, কিন্তু প্যাডেল রিকশা চালানোর লোক নেই। প্যাডেল রিকশার ড্রাইভাররা অন্য কাজ করছেন। আর অটো নেওয়ার জন্য নতুন নতুন ছেলেরা প্রতিদিন ধরনা দিচ্ছে।’
মিস্ত্রি আমিরুল ইসলাম ওই গ্যারেজে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্যাডেল রিকশাগুলো ইঞ্জিনচালিত রিকশায় পরিবর্তন করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসার ধরন পাল্টাচ্ছে, যে কারণে প্যাডেল রিকশা অটো হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই গ্যারেজের ৬০টি রিকশার মধ্যে প্রায় ২০টি অটো করা হয়েছে। পুরোনো রিকশার ফ্রেম ও চেসিসের সঙ্গে মোটর, ব্যাটারি ও রিং লাগিয়ে নতুন করে অটো করা হয়। কোনো কোনো রিকশার কাঠের বডিও পরিবর্তন করে স্টিলের করা হয়। সব মিলিয়ে খরচ হয় ৫৬ হাজার টাকা।’
এমন কয়েকজন মিস্ত্রি জানিয়েছেন, রাজধানীর কারওয়ান বাজার, পুরান ঢাকার বংশাল, যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকার অনেক এলাকায় ওইসব যন্ত্রাংশ বিক্রির বড় বাজার তৈরি হয়েছে। এমনকি পাড়া-মহল্লার মধ্যেও ওইসব যন্ত্রাংশের দোকান রয়েছে।
‘একবার পরিবারসহ অ্যাক্সিডেন্ট করেছি। এরপর আর কখনো অটো রিকশায় যাই না। নানান ত্রুটিযুক্ত এসব যানবাহনের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। যারা ওইসব গাড়িতে উঠছেন তারা ভুল করছেন। খেসারতও দিয়েছেন অনেকে।’ –কলেজশিক্ষক হাসিবুল হুসাইন
সবাই যে এসব অটোরিকশার যাত্রী, তাও কিন্তু নয়। যে কারণে প্যাডেলচালিত রিকশা এখনো রয়েছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন চালক।
আবু বক্কর নামের একজন বলেন, ‘কিছু লোক আছে অর্ধেক ভাড়া হলেও অটো রিকশায় উঠবেন না। তাদের জন্য আমাদের রুজি-রোজগার টিকে আছে।’
আরও পড়ুন অটোরিকশা ব্যবহার না করে হাঁটার পরামর্শ ডিএমপি কমিশনারের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় না চড়ার আহ্বান ডিএনসিসি প্রশাসকের বনানীতে রিকশাচালকদের আন্দোলন: ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীএরমধ্যে কথা হয় হাসিবুল হুসাইন নামের একজন কলেজ শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি ওইসব অটোরিকশায় ওঠেন না একটি দুর্ঘটনার পর থেকে। তিনি বলেন, ‘একবার পরিবারসহ অ্যাক্সিডেন্ট করেছি। এরপর আর কখনো অটোরিকশায় যাই না। নানান ত্রুটিযুক্ত এসব যানবাহনের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। যারা ওইসব গাড়িতে উঠছেন তারা ভুল করছেন। খেসারতও দিয়েছেন অনেকে।’
প্যাডেলচালিত রিকশার গ্যারেজগুলোও ধুঁকছেঢাকার অন্যতম রিকশার গ্যারেজ এলাকা মধুবাগ। সেখানে রয়েছে কয়েকটি এলাকা, যেগুলোকে গ্যারেজপট্টি বলা হয়। নতুন রাস্তার গ্যারেজপট্টিতে এক গলিতে সাতটি গ্যারেজ। সেখানে প্যাডেলচালিত রিকশা রয়েছে হাজারের বেশি।
ঘুরে দেখা গেলো, অনেক গ্যারেজে এখন প্যাডেল রিকশা খুলে যন্ত্রাংশ আলাদা করে স্তূপ করে রাখা। সেগুলো চলছে না। ওই জায়গায় অটোরিকশা রাখা ও চার্জ দেওয়ার ব্যবসা হচ্ছে।
করিম মিয়ার গ্যারেজের ব্যবস্থাপক শাহাবুদ্দিন বলেন, ওই গ্যারেজে ৫৬টি প্যাডেলচালিত রিকশা ছিল। এখন ২৮টি ভাড়া হচ্ছে। বাকি রিকশার যন্ত্রাংশ খুলে এক জায়গায় রাখা হয়েছে। সেই জায়গায় ২২টি অটোরিকশা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
শাহাবুদ্দিন অনেক বছর এ গ্যারেজে। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আগে যখন অটো ছিল না, তখন ড্রাইভাররা প্যাডেল গাড়ি চেয়েও পেতেন না। চাহিদার তুলনায় গাড়ির স্বল্পতা ছিল। এখন গাড়ি পড়ে আছে, ড্রাইভার পাওয়া যায় না।’
‘এখন আগের মতো আয় নেই। কারণ অন্যের হাতে ব্যবসা চলে গেছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে অটোর ব্যবসায় যেতে হচ্ছে। পুরোনো রিকশাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’ বলছিলেন শাহাবুদ্দিন।
‘ব্যবসা ধরে আছি। আজীবন এ ব্যবসা করেছি। অন্য কিছু জানি না। তবে আমার বিশ্বাস কখনো না কখনো ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ রিকশা বন্ধ হবে।’ –গ্যারেজ মালিক হুমায়ূন মিয়া
ওই এলাকায় সবচেয়ে বড় গ্যারেজ ‘রমজানের গ্যারেজ’। সেখানে ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মালিকের ৩৫০টা রিকশার বৈধ নম্বর প্লেট আছে। প্রতি বছর ৩০০ টাকা করে দিয়ে রিনিউ করছি। কিন্তু রিকশা যাচ্ছে ৫০ থেকে ৬০টা। বাধ্য হয়ে পুরোনো গাড়ি অটো করা হয়েছে। এখন ২৩০টি অটো গাড়ি চলে।’
হুমায়ূন মিয়া নামের একজন গ্যারেজ মালিক এখনো শুধু প্যাডেল রিকশা ভাড়া দিচ্ছেন। তিনি মনে করেন এক সময় ওইসব অটো রিকশা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা ধরে আছি। আজীবন এ ব্যবসা করেছি। অন্য কিছু জানি না। তবে আমার বিশ্বাস কখনো না কখনো ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ রিকশা বন্ধ হবে।’
দেশে কী পরিমাণ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও অন্যান্য অবৈধ তিন চাকার যানবাহন চলছে তার সুনির্দিষ্ট হিসাব সরকারের কোনো দপ্তরে নেই। তবে ২০১০ সালের দিকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠকে তিন চাকার অবৈধ যানের সংখ্যা ১০ লাখের মতো বলে উল্লেখ করা হয়।
বিআরটিএ, যাত্রী অধিকার সংগঠন, পুলিশ ও অন্য অংশীজনের হিসাবে, ব্যাটারি ও যন্ত্রচালিত তিন চাকার অবৈধ যানবাহন এখন ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে আছে প্রায় ৫০ লাখ। আর ঢাকায় আছে ১০ লাখের মতো। কেউ কেউ মনে করেন, ব্যাটারি ও যন্ত্রচালিত রিকশার সংখ্যা ১৫ লাখের কম হবে না, যা ক্রমাগত দ্রুত বাড়ছে।
এনএইচ/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম