ফরিদপুরের সালথায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘর পাওয়ার যোগ্য কৃষকদের বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে অন্যদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পেঁয়াজ সংরক্ষণের সময় অতিবাহিত হতে চললেও যারা ঘর পেয়েছেন তারা এখনো নির্মাণ কাজই শেষ করতে পারেননি। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট কৃষকেরা।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছর কৃষি-বিপণন অধিদপ্তর কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়নে উপজেলায় ৪৫টি ঘরের বরাদ্দ দেয়। পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রতিটি ঘর বাড়ির উঠান বা ফাঁকা জায়গায় মাত্র এক শতাংশ জমিতে টিন-বাঁশ, লোহা ও কংক্রিটের সমন্বয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এ ঘরের আয়তন প্রায় ৩৭৫ বর্গফুট। প্রতিটি ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য ছয়টি বায়ু নিষ্কাশন পাখা সংযুক্ত রয়েছে। মূলত ভ্যান্টিলেশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণে সংরক্ষিত পেয়াজ পচবে না। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য প্রতিটি ঘরে হাইগ্রোমিটার রয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষদের নাম পাঠালেও তাদের তালিকা অনুযায়ী কোনো কৃষক পাননি মডেল ঘর। ঘরের ডিজাইন পরিবর্তন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘর নির্মাণে অথবা বিতরণের বিষয়ে কোনো মতামত নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি সালথা উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি অফিসে নেই এ সব ঘরের তালিকা।
পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য প্রতিটি ঘর গত বছরের নভেম্বর মাসে ফরিদপুরের মেসার্স জাকির অ্যান্ড ব্রাদার্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঘরগুলোর কাজ শুরু করেন।
Advertisement
কৃষকদের অভিযোগ, চলতি বছরের ৩০ মার্চ ঘরের কাজ সমাপ্তের কথা থাকলেও ঠিকাদার ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে এখনো ঘরগুলোর কাজ শেষ হয়নি। অধিকাংশ ঘরের কাজ শুরু করলেও একটি ঘরের কাজও শেষ করেতে পারেনি তারা। এমনকি কিছু কিছু ঘরের কাজ এখনো শুরুই হয়নি। পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের দেশিয় মডেল ঘরের আশায় পেঁয়াজ চাষিরা তাদের পুরাতন ঘর মেরামত না করায় এখন পেঁয়াজ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। এছাড়া মডেল ঘর পাওয়ার জন্য সালথা উপজেলা কৃষি অফিসে ৭০ জন কৃষক আবেদন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা কৃষি অফিসের মাঠ কর্মীরা জানান, ৪৫টি মডেল ঘরের আওতায় ৪৫০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া কথা। প্রশিক্ষণ বাবদ প্রত্যেক কৃষকের জন্য এক হাজার করে টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সেই হিসেবে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অতএব কৃষকদের প্রশিক্ষণ বরাদ্দ থেকে অন্তত ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি ঘরই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় দেওয়া হয়েছে।
উপজেলার যদুনন্দি ইউনিয়নের কাজীপাড়ার বাসিন্দা মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের দেশিয় মডেল ঘরের আশায় আমি পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করি নাই। ঘরের ঠিকাদারের চাহিদামত টাকা না দেওয়ায় আমার ঘরের কাজ এখনো শুরু করা হয়নি। এখন আমি ৬-৭ শত মন পেঁয়াজ কোথায় কিভাবে সংরক্ষণ করবো? বাধ্য হয়ে কম দামে পিঁয়াজগুলো বিক্রি করে দিয়েছি।
উপজেলার নারানদিয়া গ্রামের কৃষক শাহিদ মিয়া বলেন, টাকা ছাড়া কি ঘর পাওয়া যায়? ঘর পেতে ৫০ হাজার টাকা লাগে। ঘর পেতে আমারও টাকা দিতে হয়েছে। তবে টাকাটা কাকে দেওয়া লাগবে তার নামটি বলেননি।
Advertisement
পশ্চিম পিশনাইল গ্রামের পেঁয়াজ চাষি নান্নু মোল্যা বলেন, ঘর নির্মাণের মিস্ত্রিদের খাবারের খরচ আমাদের বহন করতে হচ্ছে। এছাড়া ঘরের ফ্লোরের বালুও আমরা দিয়েছি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাকির অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জাকির হোসেন বলেন, অতিরিক্ত টাকা পয়সা নেওয়া হচ্ছে না। সমতল জায়গায় ঘরগুলো করার কথা ছিল। অনেক কৃষক সেই সমতল জায়গায় ঘর করছে না বিধায় এ সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, উপজেলাটিতে বরাদ্দের চেয়ে ঘরের চাহিদা বেশি। যার কারণে সবাইকে ঘর দেওয়া সম্ভব হয়নি। ঘর না পেয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। প্রকল্প পরিচালক তিনি নিজে এ এলাকায় এসে কৃষদের বাড়িতে গিয়ে যাচাই-বাছাই করে ঘরগুলো বরাদ্দ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুদর্শন শিকদার বলেন, মডেল ঘর পাওয়ার জন্য সালথা উপজেলা কৃষি অফিসে ৭০ জন কৃষক আবেদন করেন। কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে ৩০ জন কৃষকের নাম প্রকল্প পরিচালকের বরাবর পাঠানো হয়। সেই তালিকা থেকে কাউকেই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এছাড়া কারা এসকল ঘর পেয়েছেন সে বিষয়েও আমাদের অবগত করা হয়নি।
এ বিষয়ে সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, ঘর বিতরণ, নির্মাণ ও টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
আধুনিক পদ্ধতিতে পেয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিন বলেন, মডেল ঘরগুলো পাওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কৃষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই করে মডেল ঘরগুলো কৃষকদের সুবিধার্থে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। টাকা-পয়সা নিয়ে ঘর দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর আমাদের ডিজাইনের বাহিরে ঘর করা বা বাড়তি টাকা নিয়ে ঠিকাদার ঘর করে দিবে এ ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, তারপরও টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়ে যদি কোন কৃষক আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন তাহলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো। বিভিন্ন কারণে ঠিকাদার ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। সে অনুযায়ী এ ঘরের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
এন কে বি নয়ন/আরএইচ/এএসএম