আন্তর্জাতিক

পুতিনের টাকার মেশিন কি থেমে যাচ্ছে?

পুতিনের টাকার মেশিন কি থেমে যাচ্ছে?

কালিনিনগ্রাদ থেকে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত রাশিয়ায় এখন অনেক কিছু বদলে গেছে। গোল্ডম্যান স্যাশের এক উচ্চ-গতির সূচক ইঙ্গিত করছে, গত বছরের শেষ দিক থেকে রাশিয়ার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় পাঁচ শতাংশ থেকে শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে। রুশ উন্নয়ন ব্যাংক ভিইবি-ও মাসিক প্রবৃদ্ধির অনুরূপ প্রবণতা দেখিয়েছে।

Advertisement

দেশটির সবচেয়ে বড় ঋণদাতা সেবারব্যাংকের ব্যবসায়িক টার্নওভারের উচ্চ-গতির মাপকাঠি নিম্নমুখী। সরকারি ভাষ্য কিছুটা সংযত হলেও তারা স্বীকার করে নিয়েছে, সমস্যা দেখা দিয়েছে। এপ্রিলের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক খাতে উৎপাদন কমে গেছে চাহিদার হঠাৎ পতনের কারণে।

আরও পড়ুন>>

ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের ‘যুদ্ধবিরতি নাটক’ ও ট্রাম্পের শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন: একে অপরকে দুষছে রাশিয়া-ইউক্রেন

গত তিন বছর রাশিয়ার অর্থনীতি বেশিরভাগ পূর্বাভাসকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কারণ ছিল রাজস্ব খরচের উল্লম্ফন, উচ্চ পণ্যমূল্য এবং অর্থনীতির সামরিকায়ন। ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসনের পর বিশ্লেষকেরা রাশিয়ার বার্ষিক জিডিপিতে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সংকোচনের আশঙ্কা করেছিলেন। বাস্তবে সে বছর জিডিপি কমেছিল মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর ২০২৩ সালে ৪ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ভোক্তা আস্থা প্রায় রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। মনে হচ্ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পুতিনের ইচ্ছামতো সমঝোতা হবে এবং তাতে রাশিয়ার অর্থনীতি ২০২৫ সালে আরও ত্বরান্বিত হবে।

Advertisement

তবে হঠাৎ দেখা দেওয়া মন্দার পেছনে তিনটি মূল কারণ রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষায় অর্থনীতির ‘গঠনগত রূপান্তর’। আগে রাশিয়া পশ্চিমমুখী ছিল এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে হলেও ব্যক্তিখাতের কার্যক্রম গ্রহণ করতো; ২০২২ সালের পর থেকে রাশিয়া মূলত যুদ্ধাভিমুখী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে, যার কেন্দ্রে পূর্বমুখী বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এ রূপান্তরের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়েছে, শুধু অস্ত্র-গুলি কারখানায় নয়, চীন ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের নতুন সরবরাহ শৃঙ্খল গড়তেও। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্থায়ী মূলধন বিনিয়োগ বাস্তবিকপক্ষে ২০২১ সালের শেষের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি হয়েছে।

দ্বিতীয় কারণ মুদ্রানীতি। রাশিয়ায় মাসিক মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত চার শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার ওপর রয়েছে। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে তা ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। উদ্দাম সামরিক ব্যয় ও শ্রমিক সংকট এর জন্য দায়ী। গত বছর রাশিয়ায় মজুরি ১৮ শতাংশ বেড়েছিল, যার চাপ সরাসরি পণ্যমূল্যের ওপর পড়েছে। এর জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কড়াকড়িভাবে বাড়িয়েছে। ২৫ এপ্রিল তারা নীতিগত সুদের হার ২১ শতাংশে বহাল রাখে, যা ২০০০ দশকের শুরু পরবর্তী সর্বোচ্চ।

এ পর্যন্ত হলে হয়তো পুতিন বিশেষ চিন্তিত হতেন না। ধীরে ধীরে মন্দা হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে তা কিছুটা সহনীয় ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, এই মন্দা ধীরে নয়, হঠাৎ করে ভয়াবহভাবে ঘটছে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে তৃতীয় একটি বিষয় সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছে, সেটি হলো- বহির্বিশ্বে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্রতর হওয়ায় বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস নেমে গেছে, তেলের দামও পড়েছে। বিশেষ করে চিন্তিত করা হচ্ছে চীনের অবস্থা নিয়ে, যারা রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৫ সালে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৪ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে চার শতাংশ করেছে।

Advertisement

তেলের দাম কমে যাওয়ায় রাশিয়ার অর্থনীতিতে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে, যেখানে তেল কোম্পানিগুলো মোট মূলধনের এক চতুর্থাংশের মালিক। শীর্ষ ৫০টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মূল্য নির্ণায়ক এমওইএক্স সূচক সাম্প্রতিক সর্বোচ্চ স্তর থেকে এক-দশমাংশ কমে গেছে। রপ্তানি আয় কমে আসায় সরাসরি বাস্তবিক অর্থনীতিতে আঘাত আসছে। সরকারের কোষাগারে চাপ পড়ছে; মার্চ মাসে তেল ও গ্যাস থেকে কর আদায় আগের বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ কমেছে।

গত ২২ এপ্রিল রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এ বছর তেল ও গ্যাস বিক্রিতে বড় ধরনের পতনের আশঙ্কা করছে রাশিয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো পুতিনের প্রতি সদয় হতে পারেন, কিন্তু তার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ পুতিনের অর্থনীতিতে বড় আঘাত হেনেছে।

কেএএ/