দেশজুড়ে

১২ বছর ধরে স্ত্রীকে খুঁজছেন আতাউর, পুরো ক্ষতিপূরণ চান রেবেকা

১২ বছর ধরে স্ত্রীকে খুঁজছেন আতাউর, পুরো ক্ষতিপূরণ চান রেবেকা

সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১২ বছর আজ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন গৃহবধূ রেবেকা বেগম। স্বামী মোস্তাফিজুর রহমানকে খাইয়ে নিজে না খেয়েই পরিবারের ৭ সদস্য মিলে রানা প্লাজার দ্বিতীয় তলায় কাজ করছিলেন। পাশের লাইনে রেবেকার মা তখন ডাকছিলেন খাওয়ার জন্য।

Advertisement

হঠাৎ বিকট শব্দে ভবনটি ভেঙে পড়ে। সেই কক্ষে দুই পা দেওয়ালের নিচে চাপা পড়ে আটকা পড়েন রেবেকা বেগম। তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। দুদিন পর সেখান থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা তাকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় রেবেকা বেগমের পরিবারের দুজন কোনোমতে প্রাণে বেঁচে ফিরলেও মাসহ বাকিরা হারিয়ে গেছেন রানা প্লাজার ভেঙে পড়া ভবনে।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদিপুর ইউনিয়নের বারাইহাট চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের রাজমিস্ত্রি মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী রেবেকা বেগম (২৮)। রানা প্লাজা ধসে দুই পা হারিয়ে চির পঙ্গুত্ব জীবন বরণ করতে হয় রেবেকা বেগমকে। প্রায় ১১ মাস হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গ্রামের বাড়িতে ফেরেন তিনি। এরপর কেটে গেছে ১২ বছর। এরমধ্যে দুই সন্তানের মা হয়েছেন।

এখন কেমন আছেন রেবেকা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। তারপরও দুই সন্তানকে মানুষ করার জন্য দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চাই। মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা (১০) চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে ও ছেলে মাদানি আন্নুর (৬) নার্সারিতে পড়ে। এরমধ্যে বাম পায়ের হাড় বেড়েছে। ডাক্তার বাড়তি হাড় কাটার জন্য অপারেশন করতে বলেছেন। টাকার অভাবে অপারেশন করতে পারছি না। আমি আরও অনেকদিন বাঁচতে চাই দুই সন্তানকে মানুষ করার জন্য।

Advertisement

তিনি জানান, স্বামী মোস্তাফিজুর রহমানের সেবা-ভালোবাসা ও সহযোগিতায় হাসিমুখে দিন কাটছে তার। দুই হাতের ওপর ভর করেই ঘর-গৃহস্থালির কাজ করাসহ সন্তানদের দেখভাল করছেন রেবেকা।

রানা প্লাজা ধসের ওই দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৩৫ শ্রমিক নিহত হন। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের অনেকে এখনো আতঙ্কগ্রস্ত। বেঁচে থাকার তাগিদে কেউ নতুন পথ খুঁজে নিয়েছেন। জীবনযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।

মোস্তাফিজুর রহমান তখন সাভারে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। দুর্ঘটনার দিন রানা প্লাজার পাশেই কাজে ছিলেন তিনি। খবর পেয়ে প্রথমে স্ত্রীকে ফোন করেন কিন্তু সাড়া পান না। এরপর ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। স্ত্রীকে খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে ছুটতে থাকেন এদিক-সেদিক। মোস্তাফিজুর বলেন, আল্লাহকে বলেছিলাম জানের বদলে জান দেব, তবু স্ত্রীকে ফেরত দাও। জীবিত অবস্থায় স্ত্রীকে পেয়েছি। আমি নিজেও এতিম, এতিম দেখেই ভালোবেসে বিয়ে করেছি। ওর মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিয়েছি। অনেকে মনে করেছিলেন, ওকে ছেড়ে আমি চলে যাব। কিন্তু যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, তাকে ছেড়ে যাব কীভাবে? ওর জন্য খুব কষ্ট হয়। দূরে কোথাও কাজকামেও যেতে পারি না।

দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রেবেকা পেয়েছেন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। প্রতি মাসে সেখান থেকে পান ৯ হাজার ১০০ টাকা। সেই টাকায় ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চলছে।

Advertisement

রেবেকা বলেন, দুর্ঘটনায় যার দুই পা হারিয়েছেন তাকে দেওয়া হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এক পা হারালে ১০ লাখ। কিন্তু ভুল প্রতিবেদন দেওয়ায় দুই পা হারালেও তিনি এক পা হারানোর ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন। স্বামী কাজে যেতে পারেন না। দুই ছেলে মেয়ের জন্য হলেও বাকি ৫ লাখ টাকা তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

অপরদিকে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সন্ধান মেলেনি গুলশানে জান্নাত শাবানার। রানা প্লাজার ষষ্ঠতলায় সুয়িং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন গুলশানে জান্নাত শাবানা (২৭)। পাশেই এনাম মেডিকেলে নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে চাকরি করতেন তার স্বামী আতাউর রহমান। রানা প্লাজা ধসের ঘটনা চোখের সামনে দেখেছেন আতাউর। দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তিদের কাছে ছোটাছুটি করেছেন। জীবিত মানুষদের কাছে স্ত্রীর খোঁজ করেছেন। এরপর ১২ বছর কেটে গেলেও স্ত্রী শাবানাকে খুঁজে পাননি আতাউর রহমান।

আতাউর-শাবানা দম্পতির বাড়ি ফুলবাড়ী উপজেলার কাজিহাল ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। আলাপচারিতায় জানান, দুই সন্তান, স্ত্রী আর মাকে নিয়ে তার সংসার ছিল। ছেলে মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে ঢাকায় চাকরি করতেন স্বামী-স্ত্রী। ছেলের বয়স তখন ৫ আর মেয়ের ৩ বছর।

আতাউর বলেন, ভবন ধসের ৫ মাস পর এলাকায় ফিরে আসেন। মেয়েটা মায়ের কথা কিছুটা বলতে পারে না। মায়ের জন্য প্রথম প্রথম খুব কান্নাকাটি করত। কিন্তু ছেলের তেমন কোনো স্মৃতি নেই। এলাকায় ফিরে সন্তানদের মায়ের কাছে রেখে কৃষিকাজ শুরু করেন। বছর সাতেক আগে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সন্তান লালন-পালনে খুব সমস্যায় পড়েন। সন্তানদের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় নাম ছিল শাবানার। স্বামী আতাউর রহমান ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ১৩ লাখ টাকা। ছেলে মেয়ে নতুন মায়ের কাছে ভালোই আছে উল্লেখ করে আতাউর বলেন, টাকা হয়তো পেয়েছি, কিন্তু ১২ বছরেও স্ত্রীর মরদেহটাও দেখতে পাইনি।

এমদাদুল হক মিলন/আরএইচ/জেআইএম