শ্রমিকদের অধিকার এবং নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপত্তা অগ্রগতিকে টেকসই করে তুলতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
Advertisement
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর তৈরি হওয়া নিরাপত্তা শঙ্কা এবং শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে বেশ কয়েকজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, বিশেষজ্ঞ ও রপ্তানিকারকের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তারা জানান, শুধু আইন প্রণয়ন নয়, বাস্তব প্রয়োগ, পর্যাপ্ত পরিদর্শন ব্যবস্থা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি ‘প্রতিরোধভিত্তিক নিরাপত্তা সংস্কৃতি’ গড়ে তোলা প্রয়োজন।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে অবস্থিত রানা প্লাজার আটতলা ভবন আকস্মিকভাবে ধসে পড়ে। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক নিহত হন। গুরুতর আহত হন ২ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ। সেখানে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনাগুলোর একটি, যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বৈশ্বিক ক্রেতা, প্রস্তুতকারক এবং নীতিনির্ধারকরা গার্মেন্টস শিল্পকে নিরাপদ ও টেকসই করতে ব্যাপক উদ্যোগ নেন। কারখানার কাঠামোগত নিরাপত্তা, অগ্নিনিরাপত্তা, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে নানা ধরনের সংস্কার ও তদারকি ব্যবস্থা চালু হয়। ফলে আগের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ।
Advertisement
বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টর বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ শিল্প। বাংলাদেশের নির্মাতারা স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুরস্কার পায়। আমরা এ অগ্রগতি ধরে রাখতে সাম্মিলিতভাবে কাজ করছি, যাতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।-বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহিল রাকিব
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ কর্মপরিবেশ নিরাপদ করতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এই অগ্রগতি অর্থবহ করতে হলে এটিকে অবশ্যই টেকসই করে তুলতে হবে। শ্রমিক সুরক্ষায় ধারাবাহিক বিনিয়োগ, স্বচ্ছ নজরদারি ও কঠোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।’
আরও পড়ুন রানা প্লাজার সোহেলের জামিন স্থগিত থাকবে: আপিল বিভাগ আজও আঁতকে ওঠেন রানা প্লাজার সেই রেশমা রানা প্লাজা ধসের ‘খবর প্রচারে’ ব্যবসা হাতছাড়াসম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমি যদি বৈদ্যুতিক, অগ্নিনির্বাপক ও ভবন নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে চাই, রানা প্লাজা ভবন ধসের সময়ের তুলনায় এখন অনেক ভালো। কিন্তু আত্মতুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অগ্রগতি ধরে রাখতে এবং উন্নতি টেকসই করতে পর্যবেক্ষণ ও ক্রমাগত উন্নয়ন আবশ্যক।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিরাপত্তা অগ্রগতি টেকসই করার জন্য এটি উপযুক্ত সময়। অন্যদিকে, শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়গুলোকে টেকসই তার অংশ হিসেবে নিতে হবে। শ্রমিকরা শিল্পের অংশ। তাদের যথাযথ অধিকার পাওয়া উচিত।’
Advertisement
বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র দাবি করে বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহিল রাকিব বলেন, ‘বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টর বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ শিল্প। বাংলাদেশের নির্মাতারা স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুরস্কার পায়। আমরা এ অগ্রগতি ধরে রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করছি, যাতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।’
ন্যায্য মজুরি বা জীবনধারণযোগ্য মজুরি সময়ের দাবিকর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অগ্রগতি স্বীকার করে পোশাক শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা ন্যায্য মজুরি বা জীবনধারণযোগ্য মজুরি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
শ্রমিক উৎপাদনশীলতার নামে শ্রমিকদের জীবনধারণযোগ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা সঠিক শিল্পের জন্য ভালো নয়। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এটি ১২ বছর আগের তুলনায় অনেক ভালো।- জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘শ্রমিক উৎপাদনশীলতার নামে শ্রমিকদের জীবনধারণযোগ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা সঠিক শিল্পের জন্য ভালো নয়। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এটি ১২ বছর আগের তুলনায় অনেক ভালো। তবে আরও উন্নতির সুযোগ আছে এবং এজন্য কারখানার মালিকদের উচিত তাদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেওয়া।’
আমিন বলেন, ‘বিদ্যমান মজুরি উন্নত জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে শ্রমিকরা অপুষ্টির শিকার হয় এমনকি তাদের সন্তানরাও।’
‘আমরা শিল্পের উন্নয়নের জন্য সর্বদা শ্রমিক কল্যাণের বিষয় মাথায় রেখে কাজ করি। শ্রমিকের বেতন সরকারের নির্ধারিত হারে হয়। এখন সময় এসেছে শ্রমিকদের অধিকার ও দায়িত্বের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। উৎপাদনশীলতা ও মজুরির মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে।’ এ মন্তব্য করেন আব্দুল্লাহিল রাকিব।
ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘তাদের মনে রাখা উচিত যে আমাদের অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে, যাদের উৎপাদন ক্ষমতা আমাদের চেয়ে বেশি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে শ্রমিকদের দায়িত্ব কী এবং তারা কীভাবে তা করবে। ট্রেড ইউনিয়ন তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা উচিত।’
যৌথ দরকষাকষির অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন‘কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও সম্মিলিত দরকষাকষির অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে কিন্তু কাজের পরিবেশের উন্নতি হয়নি। সমষ্টিগত দরকষাকষি, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার এখনো পূর্ণ গতি পায়নি। ইউনিয়নে যোগদান করলে শ্রমিকদের হুমকি দেওয়া হয়।’ দাবি করেন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার।
কারখানার মালিক ও সরকারকে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
আইএইচও/এএসএ/এএসএম