গত ৯ বছরের ৩ হাজার ১১৪ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। এ অবস্থায় বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ৫ হাজার ২৫৮ শিশুসহ এক লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জনের অকালমৃত্যু ঘটে। এক গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে এ দাবি করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
Advertisement
বিশ্ব ধরিত্রী দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠন দুটি। এতে দেশের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় ৯ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধে ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বাংলাদেশে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ ঢাকার গত ৯ বছরের বায়ুমান সূচক বা একিউআই-এর তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণে পাওয়া যায় যে, ঢাকায় গত ৯ বছরের ৩ হাজার ১১৪ দিন এর মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৩১ দিন (১ শতাংশ) নির্মল বা ভালো বায়ুতে নিশ্বাস নিতে পেরেছেন। তবে এক্ষত্রে ৬২৪ দিন (২০ শতাংশ) মাঝারি বায়ু, ৮৭৮ দিন (২৮ শতাংশ) সংবেদনশীল বায়ু, ৮৫৩ দিন (২৭ শতাংশ) অস্বাস্থ্যকর, ৬৩৫ দিন (২১ শতাংশ) খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৯৩ দিন (৩ শতাংশ) দুর্যোগপূর্ণ বায়ু গ্রহণ করেন। ২০২৪ সালের সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে খারাপ বায়ুমানের দিনসংখ্যা হলো যথাক্রমে ২ ও ৩৫ দিন।
বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে কমপক্ষে ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ)- এর গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ৫ হাজার ২৫৮ শিশুসহ এক লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জন মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে। বিশেষ করে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে বায়ু ও সিসা দূষণসহ বিভিন্ন দূষণ, যা শিশুদের আইকিউ হ্রাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
Advertisement
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, বায়ুদূষণ ও শব্দ দূষণের মাত্রা এত বেশি মাত্রায় দাঁড়িয়েছে যে ঢাকা শহরে এখন বসবাস করার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দিন দিন এই দূষণের তীব্রতা বাড়ছে। এখনই এই দূষণ বন্ধ করতে না পারলে ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসবে।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম. ফিরোজ আহমেদ বলেন, মানুষ প্রতিদিন ৩০ কিউবিক লিটার বায়ু সেবন করে থাকে। এই বায়ুটুকু যদি দূষিত হয় তবে মানবদেহ মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আগে দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
আরও পড়ুন
বায়ুদূষণে কঠিন যে রোগের ঝুঁকি বাড়ে বায়ুদূষণ যেসব কঠিন রোগের কারণতিনি বলেন, বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ট্রান্সবাউন্ডারি মুভমেন্ট। বার্ষিক ১৫ থেকে ২০ মাইক্রোগ্রাম দূষণ মূলত ট্রান্সবাউন্ডারি মুভমেন্টের ফলে হয়ে থাকে। আমাদের আগে নিজের দেশের দূষণ বন্ধ করা জরুরি।
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. শহীদুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির ফলে দেশে দূষণ বেড়েছে। গত সরকার উন্নয়নের নামে একের পর এক পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ সমগ্র দেশের পরিবেশ ধংস করেছে। আমরা চাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের উন্নয়নে পরিবেশকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেবে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে নয় দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-১. দেশের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় পরিবেশ সংস্কার কমিশন গঠন করা। ২. বায়ুদূষণকারী মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করে বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি। ৩. বায়ুদূষণকারী পোড়ানো ইটের বিকল্প ব্লক ইটের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
৪. বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা। ৫. বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন, শিল্প কারখানা, গৃহস্থালি কাজসহ সব স্তরে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। ৬. আইইপিএমপি সহ বিদ্যমান জ্বালানি নীতিগুলোতে সংশোধন আনা এবং নির্মল বায়ু আইন প্রণয়ন করা। ৭. বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প কারখানায় বিশ্বমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিঃসরণ মান নির্ধারণ এবং এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। ৮. সৌর, বায়ু এবং জলবিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাস প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া। ৯. গৃহঅভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ কমাতে গ্রামীণ পর্যায়ে জীবাশ্ম জ্বলানির পরিবর্তে সবুজ জ্বালানি নিশ্চিত করা।
আরএএস/কেএসআর/এমএস