মতামত

রাজস্ব আদায় ও খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফের উদ্বেগ এবং কিছু কথা

রাজস্ব আদায় ও খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফের উদ্বেগ এবং কিছু কথা

রাজস্ব আদায় ও খেলাপি ঋণ নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইএমএফের সর্বশেষ স্টাফ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো দুর্বল রাজস্ব আদায় এবং ব্যাংকিং খাতের ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ। এই দুটো বিষয়ের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে।

Advertisement

বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দীর্ঘ সময় ধরেই অর্থনীতির আকারের তুলনায় নিম্ন স্তরে অবস্থান করছে। বর্তমানে কর রাজস্বের অনুপাত জিডিপির প্রায় ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন বলে বিবেচিত। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, ২০২২ সালে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল মাত্র ৭.৫%, যেখানে একই সময়ে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের গড় ছিল প্রায় ১৯.৩%। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশের এই অনুপাত অনেক নিচে, যেমন নেপালের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ১২ থেকে ১৩ শতাংশ এবং ভারতের প্রায় ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ। কর-জিডিপি অনুপাতের এই নিম্ন অবস্থানের কারণে সরকারের জন্য বাজেট ঘাটতি পূরণ এবং উন্নয়নমূলক ব্যয় নির্বাহ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজস্ব ঘাটতির ফলে সরকারের পক্ষে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

খেলাপি ঋণের সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বড় খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং ব্যাংকের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি।

বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ উভয়েই বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণকে জিডিপির অন্তত ১৫ শতাংশে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে। এই লক্ষ্যে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর ব্যবস্থাপনায় মৌলিক সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে, যার মধ্যে কর প্রশাসন ও করনীতি নির্ধারণকে পৃথকীকরণ, ডিজিটাল কর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, কর অব্যাহতি ও প্রণোদনা কমানো এবং করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করার সুপারিশ রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে সংস্কারের মাধ্যমে আরও দক্ষ ও স্বচ্ছ কর প্রশাসন তৈরির প্রস্তাবও করা হয়েছে।

Advertisement

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও মারাত্মক উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১.৪৬ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৯ শতাংশ। তবে প্রকৃতপক্ষে এই পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে, কারণ আদালতে স্থগিত এবং অবলোপনকৃত ঋণ এই হিসাবের বাইরে থাকে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এই হার প্রায় ২০ শতাংশ, যা ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট সৃষ্টি করছে এবং বিনিয়োগ পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, ঋণ বিতরণ সীমিত হয়ে পড়ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। খেলাপি ঋণের উচ্চহার বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিতে ফেলছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংককে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য একটি বিস্তারিত কৌশলপত্র প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৫ শতাংশের নিচে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জোরদার করা, ঋণ শ্রেণিকরণের নিয়ম কঠোর করা এবং ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, খেলাপি ঋণের সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বড় খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং ব্যাংকের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি।

Advertisement

সরকার এরই মধ্যে কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন—জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য নিয়মিত সমন্বয় করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে ভর্তুকি হ্রাস করে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। করনীতি ও কর প্রশাসন পৃথক করার বিষয়েও কাজ চলছে, যা বাস্তবায়িত হলে কর আদায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু নীতিগত ঘোষণা বা পরিকল্পনা গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়। এসব উদ্যোগের যথাযথ ও কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করলে এসব সংস্কার কার্যকর হবে না।

সর্বোপরি, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং খেলাপি ঋণের সংকট নিরসনে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন। আইএমএফের সুপারিশগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে যেতে পারবে। বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠার মাধ্যমে দেশ টেকসই ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

লেখক : কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস, স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।

এইচআর/জিকেএস