হাসান ঈমাম সুইট
Advertisement
সময়টা উত্তর আধুনিক। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, সময় কারো তোয়াক্কা করে না। বর্তমান সময়ে দুধেধোয়া নায়ক আর আদর্শ ও নীতির প্রশ্নে সন্তানকে বিসর্জন দেওয়া মা-বাবা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। এ দুই বাস্তব সত্যের সাথে প্রেমে প্রতারণা ও উত্তরাধুনিকতার এক দারুণ উপস্থাপন হচ্ছে ‘বরবাদ’।
গত ৯ এপ্রিল রাজশাহীর কাটাখালির রাজতিলক সিনেমা হলে রাত সাড়ে ৯টার শো দেখতে গিয়েছিলাম। হলভর্তি দর্শক আর তাদের উল্লাস, ‘অ্যাই জিল্লু মাল দে’, বেশ রোমাঞ্চিত করে। খুব বেশি আশা নিয়ে বাংলাদেশী সিনেমা দেখতে বসিনি অনেকদিন। ‘বরবাদ’-এর ক্ষেত্রেও তাই। সিনেমা শুরুর পর একটু বিরক্তও হয়েছি। অতিরিক্ত গতি এবং ক্লাইমেক্স থেকে গল্পটা শুরু হওয়া দেখে মনে মনে হতাশই হচ্ছিলাম। এই হতাশা ছিল বিরতি পর্যন্ত। কিন্তু নায়িকার ইউটার্ন যেন হয়ে উঠলো সিনেমার ইউটার্ন। মোড় ঘুরে গেল সিনেমার। ক্লাইমেক্স থেকে শুরু করা গল্প ভূমিকা, রাইজিং অ্যাকশন, ফল অফ অ্যাকশন ও উপসংহারের মালা হয়ে ধরা দিলো।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক উত্তর আধুনিককালের নায়কের যে সাহস, দোষ ও গুণ -- তার সবই ‘বরবাদ’-এর নায়কের মধ্যে বিদ্যমান। এই ধরনের একটি চরিত্রে শাকিব খানকে যেভাবে পর্দায় উপস্থাপন করা হয়েছে, দুর্দান্ত না বলে উপায় নেই। একজন কুখ্যাত মানুষ হিসেবে নায়ককে পর্দায় উপস্থাপন করলেও দর্শকের অনুভূতি নায়ককে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছিল। ঘৃণ্য একজন মানুষকে প্রকৃত অর্থেই নায়ক করে তোলা সিনেমার প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। শাকিব খানের অভিনয়ের কারণেই হয়তো সেটা করা গেছে। শাকিবের লুক, মোশন, অ্যাকশন এক কথায় অনবদ্য। তবে শাকিবকে কখনো কখনো ‘কেজিএফ’-এর রকি ভাই, কখনো ‘অ্যানিমেল’-এর রণবীর কাপুর বলে মনে হয়েছে। রিহ্যাবে নেশাদ্রব্যের সবগুলো তালিকায় টিক দেওয়া মনে করিয়ে দিয়েছে ‘সাঞ্জু’ সিনেমার কথা।
Advertisement
মিশা সওদাগর বরাবরের মতোই তুলনাহীন। বাংলাদেশী সিনেমায় খলচরিত্র নির্মাণে মিশা সওদাগর প্রায় ত্রিশ বছর একাই রাজত্ব করে যাচ্ছেন। ‘বরবাদ’-এ চিরপরিচিত মিশা নিজেকে ভেঙে একজন ধৈর্য্যশীল পিতা ও হিংস্র মানুষের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। একই সঙ্গে হিংস্রতা, বাৎসল্য, অসহায়ত্বে বাস্তব মনে হচ্ছিলো মিশার অভিনয়। শহিদুজ্জামান সেলিম ও ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয়দক্ষতা নিয়ে কিছু বলার নেই।
‘বরবাদ’ সিনেমায় কিছু কিছু দৃশ্য ও সংলাপ এতটাই মন কেড়েছে যে, সেগুলোর কথা বলতেই হবে। যেমন, ‘অ্যাই জিল্লু মাল দে’! শুরুতেই হাসপাতাল থেকে রোগীর সাদা গাউন পরে বের হয়ে শাকিব খানের হেলিকপ্টারে ওঠার দৃশ্য, গাড়িতে বসে সাইলেন্স বলার দৃশ্য, শেষ দৃশ্যে যিশু সেনগুপ্তের শরীরের জ্বলন্ত আগুনে শাকিবের সিগারেট ধরানো কিংবা শেষ মুহূর্তে ইধিকা পালকে গুলি করা মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো। একটি সিনেমা তখনই সফল হয় যখন, সিনেমার সংলাপ ও দৃশ্য মানুষের মনকে স্পর্শ করে। সেই দিক থেকে ‘বরবাদ’ সফল। কারণ ‘বরবাদ’র অনেক দৃশ্য ও সংলাপ মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে। এখন তো টিকটক বা ফেসবুক রিলসের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংলাপ ‘অ্যাই জিল্লু মাল দে’।
‘ড্রামা ইজ অ্যান আর্ট অব অ্যাকশন’। নির্মাতা হয়তো এই থিওরিতে এগুতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই হয়তো ডিটেইলের দিকে মনোযোগ দিতে পারেননি। ‘বরবাদ’-এ গতির সাথে যদি ডিটেইলের সমন্বয় করা যেত, তাহলে ‘বরবাদ’ চলে যেন অন্য এক উচ্চতায়। ধরা যাক, ফজলুল রহমান বাবু যেন হঠাৎই পর্দায় আবির্ভূত হলেন। তাকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। অথচ বোমা বিস্ফোরণে তাকে জড়ানো হয়েছে আসামী হিসেবে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সিনেমায় নেই। গতি ধরে রাখতে শহিদুজ্জামান সেলিম আদালতে তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে এক ধরনের ওভার অ্যাকটিং করে ফেলেছেন বলে মনে হয়েছে।
নায়িকা ইধিকা পালের অভিনয় বেশ কিছু জায়গায় দুর্বল মনে হয়েছে। তবে সিনেমার টার্নিং পয়েন্টে তার সিগারেট খাওয়ার দৃশ্যটা অনন্য। যিশু সেনগুপ্তের প্রবেশটাও দারুণ। তবে শেষে তার ভূমিকাটা বেশ দুর্বল লেগেছে। তাকে আরেকটু শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করাই যেতো। সিনেমায় পরিচালক একটু তাড়াহুড়ো করেছেন বলে মনে হয়েছে। যে কারণে কিছু কিছু জায়গা আরোপিত লেগেছে। যেমন বেশ কজন মন্ত্রীকে নায়কের একসাথে খুন করা বা নিজের মামাকে খুন করার পরও পরিবারের সদস্যদের নির্লিপ্ত থাকা অবাস্তব লেগেছে। তবে সার্বিক বিবেচনায় সেটি তেমন বড় ইস্যু নয়।
Advertisement
সার্বিক বিবেচনায় ‘বরবাদ’ সিনেমার মেকিং অসাধারণ। একে বৈশ্বিক মানের বললে ভুল হবে না। আবহসংগীতও বেশ ভালো ছিল। ‘প্রতি নিঃশ্বাসে তোমার নাম’ গানটি চমৎকার, বাকি গানগুলো হয়তো আরো ভালো করা যেতো। শুভচিন্তা দিয়ে সিনেমা শেষ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে যে প্রত্যাশা নিয়ে ‘বরবাদ’ দেখতে বসেছিলাম, তা পুরোটাই উল্টে গেছে। ২০০০ সালের পর যে বাংলাদেশী সিনেমাটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেটিই হয়তো ‘বরবাদ’।
লেখক: হাসান ঈমাম সুইট, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী।
আরএমডি/এমএস