ভূমিকা-
Advertisement
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং এই পরিবর্তনগুলির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক শিক্ষা শুধু একপাশের জ্ঞান প্রদানকারী ভূমিকা পালন করলে চলবে না, বরং এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে দক্ষতা এবং উদ্ভাবনের বিকাশের ক্ষেত্র হতে হবে। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করা প্রয়োজন যা শিক্ষার্থীদের শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয় না, বরং তাদের বাস্তব জীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং সমাধানমূলক চিন্তাভাবনা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
এখানে আউটকাম-ভিত্তিক শিক্ষা (Outcome-Based Education বা OBE) একটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে উঠে আসে। OBE হল এমন একটি শিক্ষাপদ্ধতি যেখানে শিক্ষার্থীদের অর্জিত দক্ষতা এবং তাদের শিখে নেওয়া কৌশলগুলির উপর জোর দেওয়া হয়, যা শেষ পর্যন্ত তাদের কর্মজীবন এবং সমাজে অবদান রাখতে সক্ষম করে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন নয়, বরং তাদের বাস্তব জীবনে যে দক্ষতাগুলির প্রয়োজন, তা শিখতে এবং ব্যবহার করতে সহায়তা করা হয়।
OBE এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি শুধু চাকরির বাজারে প্রবেশের জন্য নয়, বরং উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যও করা যায়। এর মাধ্যমে এমন স্নাতক তৈরি করা সম্ভব যারা কর্মসংস্থানের জন্য যোগ্য এবং কর্মজীবনের পাশাপাশি নতুন উদ্যোগ চালানোর জন্যও প্রস্তুত থাকে।এই প্রেক্ষাপটে, OBE কে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের 3ZERO তত্ত্ব (যে তত্ত্বটি দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং পরিবেশ দূষণ দূর করার লক্ষ্যে কাজ করে), ইন্ডাস্ট্রি 5.0 (যা প্রযুক্তি, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক), এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) এর সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। এই সমন্বিত কাঠামোটি একটি সামাজিক রূপান্তরের দিকে পরিচালিত করতে পারে, যেখানে শিক্ষাব্যবস্থা শুধু শিখন ও অর্জনকে নয়, বরং একটি সামগ্রিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে পরিচালিত করবে।
Advertisement
সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী একটি স্মার্ট, উদ্ভাবনী, এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। OBE-ভিত্তিক এই শিক্ষা কাঠামো শুধু অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষই আনবে না, বরং এটি একটি মানবিক ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হবে, যেখানে শিক্ষাই হবে উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি।
OBE এবং এর একীভূত দর্শন সমাজে শিক্ষা ও দক্ষতার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, যা একদিকে যেমন বেকারত্ব হ্রাসে সাহায্য করবে, তেমনি অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনা তৈরি করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের 3ZERO তত্ত্বটি বিশ্বের সঙ্কটগুলোর সমাধান হিসেবে তিনটি প্রধান লক্ষ্যকে সামনে রেখে গঠিত। এই তত্ত্বটি সামাজিক ব্যবসা এবং টেকসই উন্নয়নকে কেন্দ্র করে, যা মূলত মানবকল্যাণের জন্য কাজ করে। তিনটি লক্ষ্য হল:
জিরো দারিদ্র্য (Zero Poverty) – দারিদ্র্য নির্মূলের জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা বিকাশ। অর্থাৎ, যদি মানুষকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেওয়া যায়, তবে তারা নিজের উদ্যোগ শুরু করতে সক্ষম হবে, যা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। জিরো বেকারত্ব (Zero Unemployment) – যুবসমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে, একটি শক্তিশালী সামাজিক ব্যবসা তৈরি করতে হবে যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা মানসিকতা এবং দক্ষতা দিয়ে প্রস্তুত করার মাধ্যমে, তারা নতুন ব্যবসা শুরু করতে সক্ষম হবে। জিরো কার্বন নিঃসরণ (Zero Net Carbon Emissions) – পরিবেশের সুরক্ষায়, একে টেকসইভাবে রক্ষা করার জন্য কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে। এটি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সম্ভব, যেমন পুনঃনবীকরণযোগ্য শক্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার।OBE (Outcome-Based Education) এর মাধ্যমে এই তিনটি লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। OBE হলো একটি শিক্ষামূলক পদ্ধতি যেখানে শিক্ষার্থীদের ফলাফল বা অর্জন অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করা হয়। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা (Project-Based Learning), সমস্যা-ভিত্তিক শিক্ষা (Problem-Based Learning), এবং উদ্যোক্তা দক্ষতা (Entrepreneurial Skills) দেওয়া হয়, যা তাদের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে সহায়ক হয়।
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সোশ্যাল বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার চালু করা যেতে পারে। এই সেন্টার শিক্ষার্থীদের বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সহায়তা করবে। তারা যেমন সমাজের সমস্যাগুলোর সমাধানে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করবে, তেমনই নতুন ব্যবসায়িক ধারণা বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনেও সহায়তা করবে।
সংক্ষেপে, ড. ইউনূসের 3ZERO তত্ত্ব এবং OBE শিক্ষার মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। OBE শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও মনোভাব উন্নত করতে সাহায্য করে, যা 3ZERO তত্ত্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ইন্ডাস্ট্রি 5.0 এবং OBE (Outcome-Based Education) কাঠামো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করে, যেখানে প্রযুক্তি এবং মানবকল্যাণ একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। ইন্ডাস্ট্রি 5.0 একটি পরবর্তী পর্যায়ের প্রযুক্তিগত বিপ্লব যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), এবং অন্যান্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবকল্যাণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। এখানে প্রযুক্তি এবং মানুষ একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করে, যার ফলে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়ন সম্ভব হয়।
OBE কাঠামো ইন্ডাস্ট্রি 5.0-এর চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে নিম্নলিখিত উপায়ে: টেক-সেভি গ্র্যাজুয়েট তৈরিOBE শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে তাদের বাস্তব জীবন এবং শিল্পের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। এআই, ডেটা সায়েন্স, ব্লকচেইন, ক্লাউড কম্পিউটিং, এবং রোবটিক্সের মতো আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রি 5.0-এর জন্য প্রস্তুত করা যায়। এই ধরনের প্রশিক্ষণ তাদের কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করিয়ে দেয় না, বরং তাদের মেধার পরিসরও বাড়িয়ে তোলে, যা তাদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারে সহায়ক হবে।
হিউম্যান-সেন্ট্রিক ডিজাইনইন্ডাস্ট্রি 5.0-এর একটি মূল বৈশিষ্ট্য হল প্রযুক্তির মানবকল্যাণে ব্যবহার। OBE কাঠামোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, সামাজিক দায়িত্ববোধ, এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ শেখানো যায়, যা তাদের প্রযুক্তির ব্যবহারকে মানবকল্যাণমুখী করে তোলে। এই শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে কীভাবে প্রযুক্তি তাদের সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে এবং তারা কীভাবে প্রযুক্তি ও মানবকল্যাণের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে পারে।
ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতাOBE কাঠামোতে একাডেমিয়া এবং ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা তাদের তত্ত্বীয় শিক্ষা থেকে বাস্তব বিশ্বের চ্যালেঞ্জ এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। ইন্ডাস্ট্রি 5.0-এর দক্ষতাগুলি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ইন্টার্নশিপ, প্রজেক্ট-ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব পরিস্থিতিতে তাদের জ্ঞান প্রয়োগ করতে শিখবে। এতে শিক্ষার্থীরা শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী প্র্যাকটিক্যাল দক্ষতা অর্জন করতে পারে, যা তাদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারে সহায়ক হবে।
এইভাবে, OBE কাঠামো এবং ইন্ডাস্ট্রি 5.0 একসঙ্গে কাজ করলে একটি টেকসই এবং মানবকল্যাণমুখী প্রযুক্তি-ভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব।
OBE (Outcome-Based Education) এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) এর মধ্যে সম্পর্কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের একে অপরকে সমর্থন করে। জাতিসংঘের ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) সারা পৃথিবীজুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি রূপরেখা প্রদান করছে। OBE-এর মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষভাবে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা বৃদ্ধি করা সম্ভব, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। নিচে প্রতিটি SDG এবং তার সঙ্গে OBE-এর সম্পর্ক বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে:
গুণগত শিক্ষা (SDG 4): OBE শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের এমন দক্ষতা ও জ্ঞান প্রদান করা যা তাদের জীবনের জন্য উপযুক্ত এবং ক্যারিয়ারে সফল হতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নত হয় এবং শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, তাদের কার্যকর যোগাযোগ, সমস্যা সমাধান, এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নত হয়, যা SDG 4 এর লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করে। উদ্ভাবন ও অবকাঠামো (SDG 9): OBE শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গবেষণা এবং উদ্ভাবনী চিন্তা-ধারা গড়ে তোলা সম্ভব। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং শিল্প খাতে এটি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রকৌশল বিভাগের OBE প্রোগ্রাম শিক্ষার্থীদের বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্ভাবনী দক্ষতা এবং প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে, যা SDG 9 এর লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করে। সাশ্রয়ী ও পরিষ্কার জ্বালানি (SDG 7) এবং জলবায়ু কর্ম (SDG 13): OBE শিক্ষায় পরিবেশবান্ধব প্রকল্প এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং সাশ্রয়ী জ্বালানির ব্যবহারের ওপর ফোকাস করে। উদাহরণস্বরূপ, নবায়নযোগ্য শক্তি, শক্তির দক্ষতা, এবং পরিবেশের ওপর চাপ কমানোর জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা গড়ে তোলা। এতে SDG 7 এবং SDG 13 এর লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (SDG 1 ও SDG 8): OBE শিক্ষার মাধ্যমে উদ্যোক্তা দক্ষতা এবং স্টার্ট-আপ তৈরির জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা যায়। তারা তাদের নিজের উদ্যোগ শুরু করতে সক্ষম হয় এবং এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, যা দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, একটি OBE প্রোগ্রামে শিক্ষার্থীদের ব্যবসায়িক কৌশল, পরিচালনা, এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য দক্ষতা প্রদান করা হয়, যা SDG 1 এবং SDG 8 এর লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।এইভাবে, OBE কাঠামো SDGs-এর লক্ষ্যের দিকে শিক্ষাকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে, এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সামাজিক রূপান্তরের সমন্বিত কাঠামোশিক্ষা কেবল ডিগ্রি অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দক্ষতা বৃদ্ধি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা উন্নয়ন এবং দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির জন্য এক অত্যাবশ্যকীয় হাতিয়ার। একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে আনা প্রয়োজন, যেখানে Outcome-Based Education (OBE) পদ্ধতি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কেবল অ্যাকাডেমিক সফলতা অর্জনের সুযোগই নয়, বরং বাস্তবিক সমস্যার সমাধান ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ক্ষমতা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
এক্ষেত্রে, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তরের ভিত্তি হতে পারে: ১. ইন্ডাস্ট্রি 5.0 ও OBE-এর সংযোগইন্ডাস্ট্রি 5.0 হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী ধাপ, যেখানে মানব ও মেশিনের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আরও ব্যক্তিগতকৃত, টেকসই এবং উদ্ভাবনী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এটি প্রযুক্তির অগ্রগতির পাশাপাশি নৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেয়।
➡ সংযোগের মূল দিক:
OBE পদ্ধতি প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে গুরুত্ব দেয়, যা শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রি 5.0-এর চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুত করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) ও মানব-কেন্দ্রিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করা। ২. 3ZERO ও OBE-এর সংযোগ3ZERO ধারণাটি মূলত নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস-এর সামাজিক ব্যবসায় মডেলের উপর ভিত্তি করে, যা তিনটি মূল লক্ষ্য পূরণে কাজ করে:
Zero Poverty (শূন্য দারিদ্র্য) Zero Unemployment (শূন্য বেকারত্ব) Zero Net Carbon Emission (শূন্য কার্বন নির্গমন)➡ সংযোগের মূল দিক:
OBE শিক্ষার্থীদের কেবল চাকরির জন্য প্রস্তুত না করে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য দক্ষ করে তোলে। সামাজিক ব্যবসার ধারণার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা, যাতে তারা নিজেরা কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। টেকসই এবং দায়িত্বশীল ব্যবসা পরিচালনার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা। ৩. SDGs ও OBE-এর সংযোগসাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (SDGs) হলো জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১৭টি লক্ষ্য, যা বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে SDGs-এর সংযোগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
➡ সংযোগের মূল দিক:
OBE-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা অর্জন করানো। পরিবেশগত দায়িত্ব, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং শিক্ষাগত সমতা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা। গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখা।উপর্যুক্ত তিনটি সংযোগের মাধ্যমে আমরা এমন একটি সামাজিক রূপান্তরের কাঠামো গড়ে তুলতে পারি, যেখানে শিক্ষার্থীরা কেবল জ্ঞান অর্জনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তারা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হবে। এটি একাধারে দক্ষ কর্মী, উদ্যোক্তা, গবেষক এবং দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে, যা আমাদের সমাজ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
উপসংহার-Outcome-Based Education (OBE) কেবল একটি শিক্ষাদর্শন নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার। বর্তমান বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি, শিল্প বিপ্লব ৫.০ (Industry 5.0), এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে। এর সাথে 3ZERO তত্ত্ব—যা দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং নিট ওয়েস্ট মুক্ত একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণের ধারণা দেয়—সমন্বিতভাবে একটি শক্তিশালী শিক্ষা কাঠামো তৈরি করতে পারে।
যদি আমরা OBE, 3ZERO তত্ত্ব, Industry 5.0, এবং SDGs-কে একত্রিত করতে পারি, তাহলে এটি শিক্ষাকে শুধু চাকরির জন্য দক্ষ জনশক্তি গঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে না। বরং এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্যোক্তা মানসিকতা বিকাশ করবে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে, এবং সমাজে গঠনমূলক পরিবর্তন আনার জন্য তাদের প্রস্তুত করবে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নীতিগত সংস্কার, শিল্প ও একাডেমিয়ার মধ্যে কার্যকর অংশীদারিত্ব, সোশ্যাল বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন, এবং বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ প্রদান করে তাদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা আগামী দিনের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী একটি স্মার্ট, উদ্ভাবনী, এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। OBE-ভিত্তিক এই শিক্ষা কাঠামো শুধু অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষই আনবে না, বরং এটি একটি মানবিক ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হবে, যেখানে শিক্ষাই হবে উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি।
লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। ডিন, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ।
এইচআর/জিকেএস