পঞ্চাশের দশকের কথা। আমি তখন হাই স্কুলের ছাত্র। আমার আব্বার একটা ফিলিপ্সের রেডিও ছিল, একেবারে নতুন, এবং সেটি তিনি যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন। বিশেষত ঈদের চাঁদ দেখার খবর শোনার জন্য রেডিও ধরে বসে থাকতেন সেই বিকেল থেকে। তারপর যখন ঘোষণা আসতো ঈদের চাঁদ দেখা গেছে, আমার আব্বা একটা চিৎকারে জানান দিতেন পাড়াপড়শিকে। আর যখন কবি নজরুলের লেখা, ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ …’ গানটা বেজে উঠত, আব্বার আনন্দ আর নাচন দৃশ্য ছিল অভূতপূর্ব । ছেলেমেয়েদের রোজা রাখা না রাখার ব্যাপারে আমার আম্মা ছিলেন ‘কট্টরপন্থি’ তবে আব্বা লিবারেল ছিলেন বলে বাঁচোয়া । তারপরও শিশু বয়সেই বেশ কয়েকটা রোজা রাখতে হতো। আর আমাদের শৈশবের রোজা মানে এমকি থুতু কণ্ঠনালি দিয়ে ভেতরে নেয়া যাবে না, অতএব সারাদিন থুতু ফেলতে ফেলতে জীবন জেরবার।
Advertisement
ঈদের দিন মূল খাবার দুধ দিয়ে ঘরে বানানো সেমাই; পরিচ্ছদ পাজামা, পাঞ্জাবি এবং কিস্তি টুপি। ঈদের জমায়েতে জায়নামাজ বগলে করে আব্বার পিছু পিছু যেতাম; সারাদিন কোলাকুলি আর পাড়া বেড়ানো, কোনো এক ফাঁকে ঘরে ঢুকে পোলাও -কর্মা খেয়ে যাওয়া। ঈদ মানে খুশির দিন।
অনুমান করা হচ্ছে যে এবারের অর্থাৎ ২০২৫ সালের রোজার ঈদে সারাদেশে চব্বিশ লক্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দুই লক্ষ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে। আরও জানা যায় যে, বাংলাদেশে সারা বছর যত জুতা বিক্রি হয়, তার প্রায় একতৃতীয়াংশ বিক্রি হয় ঈদের আগে এবং ব্যবসায়ীরা আশা করছেন আসছে ঈদ উপলক্ষ্যে তাদের বিক্রি বাড়বে ৩৫-৫৫ শতাংশ, গাড়ির জন্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধি।
আমার ঈদের আনন্দের সেই দিনগুলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়ও ছিল। ক্লাবসংলগ্ন টেনিস কোর্টে নামাজ পড়ে কোলাকুলি শুরু হয়ে শেষ হতো মধ্য রাতে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে নতুন জামাকাপড় পরে পাড়া বেড়াচ্ছে।
Advertisement
দুই. বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে কিংবা তারও পরে টের পাই যে ঈদের খুশির দিনটি দু দিক থেকে আনন্দময়। ঈদ যেমন ব্যক্তির জীবনে, তেমনি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখবরের জায়গা। একটি মাইক্রো লেভেলে– যেমন ব্যক্তি বা খানা পর্যায়ে যা একটু পূর্বে বললাম, অন্যটি ম্যাক্রো বা সমষ্টি পর্যায়ে– যেমন দেশের সবার জন্য ঈদের আনন্দ।
একটা তথ্য দেয়া যাক। অনুমান করা হচ্ছে যে এবারের অর্থাৎ ২০২৫ সালের রোজার ঈদে সারাদেশে চব্বিশ লক্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দুই লক্ষ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে। আরও জানা যায় যে, বাংলাদেশে সারা বছর যত জুতা বিক্রি হয়, তার প্রায় একতৃতীয়াংশ বিক্রি হয় ঈদের আগে এবং ব্যবসায়ীরা আশা করছেন আসছে ঈদ উপলক্ষ্যে তাদের বিক্রি বাড়বে ৩৫-৫৫ শতাংশ, গাড়ির জন্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধি। এই বিক্রির লিঙ্কেজ এবং গুণক প্রতিক্রিয়া বেশ ব্যাপক– হয়তো কয়েক লক্ষ কোটি টাকার মতো হবে যা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পরে কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করবে। সুতরাং, ঈদ শুধু একটা উৎসব নয়, ঈদ বাণিজ্য ও সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার । কাপড় থেকে জুতা, মুদি থেকে মূল্যবান অলংকার, বাজারের প্রতিটি কোণ গভীর রাত, কোথাও সারারাত, অবধি খোলা থাকে। এমনকি ফুটপাথের চায়ের টঙে টুনটুন আওয়াজ, শ্রমজীবীদের আড্ডা, মাঝ রাতেও অভিভাবকেরা হাত ধরে ষোড়শীর গভীর রাতে বাড়ি ফেরা ঈদের অবদান। অতএব, ঈদুল ফিতরের প্রচণ্ড প্রভাব যেমন মাইক্রো লেভেলে তেমনি প্রভাব ম্যাক্রো লেভেলেও।
তিন.কিন্তু রমজানের ঈদ কেন্দ্রীক এই আনন্দের বন্যার সাথে কষ্টের কথা না বললেই নয়। পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা তাদের পাওনা বোনাস ও বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে পুলিশের মার খায় যদিও অধিকাংশ কারখানা পাওনা পরিশোধ করেছে। এ দেশে কারখানার মালিক দেশে বিদেশে গাড়ি -বাড়ি ধন-সম্পদ গড়ে শ্রমিকের ঘাম তথা রক্তের বিনিময়ে অথচ এদের সামান্য পাওনাটা বুঝিয়ে দিতে গড়িমসি নানা বাহানায়। বিকৃত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এমনটি হবার কথা। অন্য দিকে, ঈদের দিনেও হাত পেতে দানখয়রাত নেয় সমাজের একটা শ্রেণি । দরিদ্র ও হত দরিদ্র এবং শ্রমিক শ্রেণীর ‘কেষ্ট হাসি’ হাসি মার্কা ঈদের আনন্দের কথা নাই বা বলা হল।
চার.তাছাড়া এবারের রোজার সময়টা রাজনৈতিক অস্থিরতায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে খুব একটা সুখদায়ক হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রস্তাবনা, জাতীয় নির্বাচন এবং আগামী সরকারের রূপরেখা এবং সম্ভাব্য সফলতা নিয়ে রাজনীতির মাঠ যখন উত্তপ্ত। ঈদের পর কী যে অবস্থা হবে কেউ বলতে পারছে না, চারিদিকে আতঙ্ক গুজব ও গজবের এই দেশে। শুধু এটুকুই নিশ্চিত যে, সম্ভবত একটা বিশাল সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে দুশ্চিন্তা ঈদের আনন্দ মাটি করার জন্য।
Advertisement
কিন্তু আপাতত আমরা আনন্দে থাকতে চাই। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করতে চাই ঈদ নিয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ গানের জন্য-“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহদে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ,ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে,যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী,সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ,ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তোর তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থনীতিবিদ। কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম