নিজের লেখাপড়া, ক্যারিয়ার গড়া, শখ ও স্বপ্ন পূরণে সফল হওয়া এক অদম্য মেধাবীর নাম হাসনাত হান্নান তামিম। হার না মানা, স্বপ্নবাজ ও পরিশ্রমী যুবক নিজ গ্রামে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয়ের অর্থ দিয়ে রাজধানী ঢাকাতে ফ্ল্যাট (ভাড়া) নিয়ে থাকা, নিজের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করা, পছন্দের বাইক কেনা, ইচ্ছেমতো দেশ-বিদেশ ঘোরা এবং নিজের গ্রামের বাড়িতে আর্থিক সাপোর্ট দেওয়াসহ বন্ধু-স্বজনদের প্রয়োজনে পাশে থেকে উদাহরণ হয়ে উঠেছেন এই তরুণ। হাসনাত হান্নান তামিমের স্বপ্নজয় ও সাফল্যের গল্প জানিয়েছেন জাগো নিউজকে।
Advertisement
পুরো নাম হাসনাত হান্নান তামিম। বয়স ২৩ বছর। ড্যাফডিল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে সবে। তার বাড়ি মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলা সদরে। বাবার নাম এস আর এ হান্নান পেশায় তিনি সাংবাদিক। মা তানিয়া হান্নান গৃহিণী। একমাত্র ছোট ভাই হামিম হান্নান টমাস, এবছর এস এস সি পরীক্ষা দেবে।
হাসনাত হান্নান তামিম একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার এবং ওয়ার্ডপ্রেস ডেভলপার। বর্তমানে ফাইভারে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার এবং ওয়ার্ডপ্রেস ডেভলপার এবং ৯৯ ডিজাইনে একজন ব্রান্ডিং স্পেসালিস্ট হিসেবে ফ্রিল্যান্স করছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মতো চ্যালেঞ্জিং এই খাত থেকে তিনি প্রতিমাসে গড়ে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করছেন।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি তার নিজের একটা ছোট স্টার্টাপ রয়েছে, যার নাম ‘পেনএক্সটুল’ । যেখানে সব ধরনের ফ্রিল্যান্স সার্ভিস পাওয়া যায়। এটির পাশাপাশি তিনি নতুন একটা স্টার্টাপের পরিকল্পনা করছেন। যার নাম ‘ডেভফিন্স’। তার সঙ্গী তুহিন, যার কাছ থেকেই তামিমের কাজ শেখা। এটির কার্যক্রমও চলমান। হাসনাত হান্নান তামিম আশা করছেন, এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেটি লঞ্চ করবেন।
Advertisement
তামিমের প্রথম কাজ ছিল একটি লোগো ডিজাইনের। ফাইভারে অ্যাকাউন্ট খোলার চার মাস পর তিনি কাজটি পান এবং সেই কাজে তিনি ১০ ডলার চার্জ করেন। মধ্যবিত্ত্ব পরিবারের ছেলে হাসনাত হান্নান তামিম। তবে খুবই উদ্যমী এবং মেধাবী। ছোটবেলা থেকেই নিজের ইচ্ছা ছিল নিজে টাকা ইনকাম করবে। ২০১৬ সালে নিজের কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ থাকার কারণে ইউটিউব ঘাটাঘাটি করতেন। ইউটিউব থেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের ধারণা পান। তবে সঠিক কোনো মেন্টর এবং গাইডলাইন না থাকার কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ের ভূতটা তার মাথায় জোরেশোরে চেপে বসেছিল।
২০২০ সালের ঘটনা। সহপাঠীদের নিয়ে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন তামিম। তখন একজন লোক এসে তাদেরকে টেবিল থেকে উঠিয়ে দিয়ে টেবিলটি দখল করে বসলো। এ ঘটনায় সেদিন মনে মনে খানিকটা রাগ হয়েছিল তার। কে না কে এসে বসলো আর তাদের উঠিয়ে দিল। পরে পাশের একটি টেবিলে বসলেন তারা। ভেতরে রাগ জমেই আছে। এমন পরিস্থিতিতে ওই ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে তার ল্যাপটপটা বের করলেন এবং কিছু একটা ডিজাইন করা শুরু করলেন। তামিমের নজরে পরে ব্যাপারটি।
দেখতে লাগলেন সেই ভদ্রলোকটা কী করেন! ডিজাইন শেষ করে একটা সাইটে ঢুকে তার ডিজাইনগুলো ডেলিভারি দিলেন। একটু আধটু ধরাণা থাকায় বুঝতে পারলেন যে, সেই ভদ্রলোকটি ফ্রিল্যান্সিং করেন। তামিম এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কী করেন? উত্তর শুনে একটু খুশি হলেন। বললেন, তিনি ফাইভার মার্কেটপ্লেসে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং করেন। তখন তামিমও তার ইচ্ছার কথা অর্থাৎ ফ্রিলান্সিং করার আগ্রহের বিষয়টি শেয়ার করেন।
এরপর সেই ভদ্রলোকটি তাকে একটা মোটামুটি কনফিগারেশনের ল্যাপটপ ক্রয়ের কথা জানান। সেই আলাপ শেষ করে বাড়িতে ফেরেন হাসনাত হান্নান তামিম। বাড়িতে গিয়ে তিনি তার মাকে জানান যে, একটি ভালো ল্যাপটপ কিনে দিতে। ছোটবেলা থেকেই তার জেদ বেশি। যা বায়না ধরতেন, তাই-ই পেতেন বাবা-মা’র থেকে। যে কথা, সেই কাজ। পরের দিনই নতুন ল্যাপটপ হাতে পেয়ে যান তিনি। সেদিনের সেই আবেগ, অনুভূতি আর খুশি দেখে কে!
Advertisement
সেদিন বিকালেই নতুন ল্যাপটপটি কাঁধে নিয়ে সেই ভদ্রলোকের খোঁজে বের হন। লোকটির দেখা পান এবং কথা একদম চূড়ান্ত করে রাতেই চলে যান তার অফিসে। এই ভদ্রলোকটির নাম তুহিন আল-মামুন। কাজ শেখা থেকে অ্যাকাউন্ট খোলা পর্যন্ত তার অবদান অপরিসীম। একটা সময় চাচা-ভাতিজা হিসেবে তাদের দুইজনের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
কাজ শেখার পর থেকে দুইজনের সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে ওঠে। কারণ তুহিন ছিলেন তামিমের জন্য যথেষ্ট সাপর্টিভ একজন মানুষ। তিনি বন্ধুসূলভ আচরণের মাধ্যমে তামিমকে গড়েন। এরপর তুহিন তার নিজের অ্যাকাউন্টের কিছু কাজ তামিমকে দিয়ে করাতে থাকেন, যাতে তামিম মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে দরকারি ও প্রয়োজনীয় সব ধারণা রপ্ত করতে পারেন।
তামিম তখন প্রস্তুত। নিজের অ্যাকাউন্টও খোলা হলো। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আরও বেশি মনোযোগী হলেন। কাজের শুরতে তুহিন তাকে লোকাল কিছু বায়ার দেয়, যাদের কাজ করে তামিম মোটামুটি নিজের হাত খরচের টাকা সহজেই বের করতে পারেন এবং পরিবারকে মোটামুটি সাপোর্ট দেওয়া শুরু করেন।
করোনাকালে লকডাউনে তামিমের হাতে তুলণামূলক কম কাজ ছিল। তখন কাজের পেছনে খেয়ে না খেয়ে লেগে ছিলেন। এমনো রাত গেছে, কাজ করতে করতে কখন ভোর হয়ে গেছে, তিনি তা বুঝতেই পারেননি। তার বাবা ও মা তাকে খুবই সাপোর্ট করতেন।২০২০ সাল। রোজা শুরু হয়ে গেলো। রোজার মাসটা লোকাল বায়ারদের কাজ করতে করতে যখন শেষ রোজা আসলো, ঠিক ঈদের আগের দিন। ১০ ডলারের একটা কাজ পেলেন। ঈদের আগের দিন, ঈদের খুশি পেয়ে গেলেন! সেই রাতেই বায়ারের কাজটি যথাযতভাবে সম্পন্ন করে ডেলিভারি দেন এবং ৫স্টার পান।
তারপর মাঝে মাঝে বিভিন্ন অংকের কাজ পেতে থাকেন তিনি। এরপর তামিমের মধ্যে কাজের স্পৃহা আরও বেড়ে যায়। অ্যাকাউন্টের রিভিউ ভালো হয়, বায়ার আসতে থাকে। কাজ করতে করতে এক সময় ৪০০ ডলার ইনকামের মাইলফলক পার করেন এবং লেভেল ১ ব্যাজ পান, যা ৪০০ ডলার ইনকাম হওয়ার পর দেওয়া হয়। এরপর উদ্যমী ও পরিশ্রমী হাসনাত হান্নান তামিমকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
বর্তমানে তিনি লেভেল ২’তে আছেন। মোট ইনকাম ফাইভারে ৬৬ হাজার ডলারেরও বেশি। ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত, নিজের ব্যক্তিগত বায়ার এবং অন্যন্য মার্কেটপ্লেস থেকে ৭৫ হাজার ডলারেরও বেশি ইনকাম করেছেন হাসনাত হান্নান তামিম। শুরু করেছিলেন একটা ল্যাপটপ দিয়ে। এখন তিন লাখেরও অধিক টাকার সেটআপে বসে কাজ করেন তিনি। বিগত পাঁচ বছর যাবত পরিবার থেকে টাকা নেন না বরং পরিবারকে নিজের সাধ্য মত দিয়ে যাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকাতে একটা ফ্ল্যাট বাসা নিয়ে থাকা, নিজের দৈনন্দিন খরচ, সঙ্গে পড়ালেখার যাবতীয় ব্যয়ভার তার উপার্জিত অর্থ দিয়েই নির্বাহ করছেন।
হাসনাত হান্নান তামিম চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলা সদরে শিফট হওয়ার কথা ভাবছেন। কারণ তার ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। তার কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি। যেটি নির্মাণ সম্পন্ন করতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮০ লাখ টাকা। তার নিজের কোনো শখ পূরণ করা বাকি নেই। এরইমধ্যে তার প্রায় সব শখ ও স্বপ্ন পূরণ করে ফেলেছেন।
আরও পড়ুন বাংলাদেশের গেমিং ইন্ডাস্ট্রি: বিলিয়ন ডলারের ভবিষ্যৎ ডিজিটাল দুনিয়ায় নারীর অবস্থানকেএসকে/জিকেএস