প্রবাস

ভোট নয়, সেবার নিশ্চয়তা-উন্নতির চাবিকাঠি প্রশাসনের সংস্কার

অশিক্ষা ও বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো মিথ্যা আশার সুরে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। মিষ্টি কথায় ভোট কিনে ক্ষমতা দখল করে তারা উন্নয়নের সুযোগগুলো নিজেদের স্বার্থে কেড়ে নেয়, আর সাধারণ মানুষ থেকে যায় বঞ্চিত। এই স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদরা আমাদের দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন কি শুধুই ভোটের রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল? না, বরং সুশাসন ও দক্ষ প্রশাসনই পারে জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে।

Advertisement

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। প্রতিবারের নির্বাচনে জনগণ উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর প্রতিশ্রুতিগুলো ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়। প্রশাসনের দুর্বলতা ও দলীয়করণের ফলে দুর্নীতি বেড়েই চলছে, আর জনগণ এর প্রধান ভুক্তভোগী।

রাজনীতির মঞ্চে উন্নয়নের বুলি শোনা গেলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। নির্বাচনের আগে নেতারা স্বপ্ন দেখান, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেন না। ফলে প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয় না। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা। নির্বাচনকালীন সহিংসতা, অনিয়ম ও দলীয় প্রভাব প্রশাসনের কার্যকারিতা নষ্ট করছে। একদল ক্ষমতায় এলে প্রশাসন তাদের স্বার্থে পরিচালিত হয়, ফলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নষ্ট হয়। যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল শক্তি প্রশাসন, কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে সেই কাঠামোই দুর্বল হয়ে পড়েছে।

Advertisement

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য এখন আর কেবল ভোটের গণতন্ত্র যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রয়োজন সেবাধর্মী প্রশাসন, যেখানে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে। উন্নত দেশগুলোর মতো শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে না পারলে উন্নয়নের সব প্রতিশ্রুতিই কেবল কাগজে রয়ে যাবে। এখন সময় প্রশাসনকে রাজনীতির হাত থেকে মুক্ত করে প্রকৃত জনসেবায় রূপান্তরিত করার। কারণ প্রকৃত গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটাধিকার নয়, বরং সুশাসনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতেও অব্যবস্থাপনা চলছে। গুণগত শিক্ষা অভাবের কারণে জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা কম এবং তারা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। অপরদিকে, স্বাস্থ্যখাতে স্বল্পমানের সেবা সাধারণ জনগণকে বঞ্চিত করছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক নেতারা জনগণের কল্যাণের চেয়ে নিজেদের স্বার্থে বেশি মনোযোগী হচ্ছেন। এর ফলে দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রশাসন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে।

এছাড়া, দেশের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেমন খুন, ধর্ষণ, চুরি ও মাদক ব্যবসা বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা না থাকায় অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না। সাইবার অপরাধও বাড়ছে, যা নিরাপত্তাহীনতাকে আরও প্রকট করছে।—

Advertisement

বাংলাদেশে প্রশাসন যদি দক্ষ হয়, তাহলে উন্নয়ন সহজে সম্ভব। প্রশাসন দুর্নীতি কমিয়ে, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে। গণতন্ত্র যদি দক্ষ প্রশাসনের ভিত্তিতে না দাঁড়ায়, তবে তা জনগণের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

নিরাপত্তাহীনতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে। অপরাধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে এবং ব্যবসায়িক আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হওয়া, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় অনিয়ম গণতন্ত্রের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

সন্ত্রাস মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ঘোষণা করুন একটি নতুন পৃথিবী গড়ার প্রত্যাশা

সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন, দুর্নীতিমুক্ত সরকার এবং কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত না হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন সম্ভব নয়। প্রশাসনের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম হবে।

বাংলাদেশে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার অনেক জায়গায় সংকুচিত। সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের প্রতি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমন এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের লক্ষণ। এর ফলে সমাজে বিভাজন এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে, আন্তর্জাতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।

নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে সাধারণ জনগণ কার্যকর সমাধান পাচ্ছে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কাঠামো দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর কার্যকারিতা এখনও পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার সংগ্রাম এবং দলীয় সংকীর্ণতার কারণে প্রশাসন কার্যকরভাবে কাজ করতে পারছে না।

গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা, বিশেষত রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতির কারণে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। দলীয় স্বার্থে কাজ করার ফলে নির্বাচিত সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় নীতিতে একগুঁয়ে আচরণ করছে, যা জনগণের জন্য ক্ষতিকর। শিক্ষা ও সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না হওয়ায় জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে।

এ অবস্থায়, গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী প্রশাসন স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। উন্নত দেশগুলো, যেমন সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া, প্রশাসনকে শক্তিশালী করে উন্নয়ন অর্জন করেছে।

বাংলাদেশে প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে হলে প্রথমত, প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতার উন্নয়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়িয়ে সেবার মান উন্নয়ন করতে হবে এবং প্রশাসনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

গণতন্ত্রের পতন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তবে, যদি গণতন্ত্র সঠিকভাবে কার্যকর হয়, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে, যা উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে অর্থনীতি বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মঞ্চে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হবে।

বাংলাদেশের উন্নতির জন্য প্রযুক্তি, প্রশাসনিক সংস্কার এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন অপরিহার্য। একটি দেশকে দ্রুত উন্নত করতে হলে শিক্ষা, প্রযুক্তি, প্রশাসনিক সংস্কার এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। উন্নত দেশগুলো যেমন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং এস্তোনিয়া তাদের জনগণকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলেছে। বাংলাদেশেও এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।

প্রথমত, প্রযুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে, যেমন চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া করেছে। বাংলাদেশে প্রতিটি স্কুলে কোডিং, রোবোটিক্স, এবং ডাটা অ্যানালিটিক্স শেখানো উচিত। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা খাতে দুর্নীতি দূর করতে হবে এবং ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তৃতীয়ত, অনলাইন শিক্ষা ও ইন্টারনেট সহজলভ্য করে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি ইন্টারনেট প্রদান করা প্রয়োজন।

এস্তোনিয়া সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে দুর্নীতি প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশেও সব সরকারি কাজ অনলাইনে করার মাধ্যমে জনগণের অভিযোগ জানানোর সহজ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখতে হবে এবং সরকারি নীতিতে মতামত জানাতে ‘ওপেন গভর্নমেন্ট’ পদ্ধতি চালু করতে হবে।

এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ১-৩ বছরের মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, ৩-৫ বছরের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা, এবং ৫-১০ বছরের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসন চালু করা উচিত।

বাংলাদেশের উন্নতির জন্য সুশিক্ষা, প্রযুক্তি, প্রশাসনিক সংস্কার এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন অপরিহার্য। উন্নত দেশগুলো প্রমাণ করেছে, সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি দেশ দ্রুত উন্নতি করতে পারে। বাংলাদেশেও প্রশাসনকে আধুনিক, দক্ষ এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ করা গেলে, উন্নয়ন দ্রুত এবং টেকসই হবে।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন) Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/এমএস