বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঐতিহাসিক পঞ্চ পাণ্ডব হলেন- মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এই ৫ ক্রিকেটারের যুগলবন্দী বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক সাফল্যের সূচনা করেছে। তাদের হাত ধরে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চূড়ায় উন্নীত হয়েছিলো।
Advertisement
পঞ্চ পাণ্ডবের একসঙ্গে পথচলা থেমে যেতে থাকে ২০২০ সাল থেকে। মাশরাফি বিন মর্তুজা অলিখিতভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নেয়ার পর থেকে। এরপর গত ৫ বছরে একে একে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে যেতে থাকেন বাংলাদেশের বিখ্যাত ৫ ক্রিকেটার বা পঞ্চপাণ্ডব। সর্বশেষ ১২ মার্চ, ২০২৫ সালে শেষ হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটে পঞ্চ পাণ্ডবের অধ্যায়। যদিও মুশফিকুর রহিম এখনও টেস্ট খেলে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
মাশরাফি বিন মর্তুজা
টেস্ট থেকে আদতে তিনি অবসর ঘোষণা করেননি। ২০০৯ সালে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে চোট পেয়ে টেস্ট থেকে ছিটকে পড়েছিলেন, এরপর আর এই ফরম্যাটে ফেরা হয়নি। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর শোনা গিয়েছিলো, তিনি টেস্টে ফিরতে পারেন। কিন্তু পায়ের অবস্থা তাকে টেস্টে আর ফিরতে দেয়নি।
Advertisement
২০১৭ সালে তৎকালীন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ওপর ক্ষোভ থেকে আকস্মিক টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলে দেন মাশরাফি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের টস করতে গিয়ে এই ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন এবং ওই সিরিজটাই খেলেন সর্বশেষ।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর গুঞ্জন ওঠে মাশরাফি ওয়ানডেকেও বিদায় বলে দেবেন। তবে, ২০২০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিলেটে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে অধিনায়কত্ব ছাড়েন; কিন্তু ওয়ানডে থেকে অবসরের ঘোষণা দেননি। তার ইচ্ছা ছিল, মিরপুরে একটি ম্যাচ খেলবেনম, যেটাতে বিসিবি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাবে; কিন্তু সেই ওয়ানডে ম্যাচটি আর মাশরাফির খেলা হয়ে ওঠেনি, ক্রিকেট মাঠ থেকে তার বিদায়ও নেয়া হয়নি।
সাকিব আল হাসান
বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হলেন সাকিব আল হাসান। সাফল্য এবং বিতর্ক- দুটি সমান্তরাল রেল লাইনের মত পাশাপাশি হেঁটেছে তার ক্যারিয়ারে। ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরুর পর থেকে পুরো ক্যারিয়ারেই বলতে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের শীর্ষ আলোচিত তারকা ছিলেন তিনি। অধিকাংশ সময় পারফরম্যান্স দিয়ে, কখনো কখনো মাঠের বাইরের অপ্রীতিকর ঘটনা দিয়ে তিনি সব সময় আলোচনায় থাকতেন।
Advertisement
দীর্ঘ সময় আইসিসির তিন ফরম্যাটেই শীর্ষ অলরাউন্ডার হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত ছিলেন। সেই সাকিব আল হাসান তো মাঠ থেকে বিদায় নিতে পারলেনই না, বরং ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি মেলাতে গিয়ে দেশের একটা অংশের কাছে নিন্দনীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছেন।
আওয়ামীলীগ থেকে সংসদ সদস্য হওয়ার কারণে ২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনে নীরব ভূমিকা পালন করেন। এরপর থেকে আর দেশে ফেরা হচ্ছে না সাকিবের। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে গিয়ে অবসরের কথা ঘোষণা করেন সাকিব। জানিয়ে দেন টি-টোয়েন্টি থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়ে ফেলেছেন। বিদায়ী টেস্ট ম্যাচটা খেলতে চান ঢাকার মিরপুরে। ওয়ানডে চালিয়ে যাবেন এবং আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হয়তো তার শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হতে পারে।
এ ঘোষণা হিসেবে ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলা ছিল সাকিবের শেষ টি-টোয়োন্ট। রাজনৈতিক কারণে দেশের মাটিতে শেষ টেস্ট খেলতে চাইলেও আসতে পারেননি, খেলতেও পারেননি। একই কারণে ওয়ানডে দলেও আর সুযোগ পাননি। এরই মধ্যে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শেষ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে সাকিবের আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার নিশ্চয়তা নেই। অর্থ্যাৎ মাঠ থেকে অবসর নিতে পারেননি তিনিও।
তামিম ইকবাল
তামিম ইকবালের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে হয়েছে বেশ নাটক। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে হঠাৎই ৬ মাসের বিরতি নেন তিনি। এরপর জুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর হঠাৎ করেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তামিম জানালেন তিনি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছেন। সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি তিনি খেলেছেন, ২০২০ সালে মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।
এরপর ওয়ানডে এবং টেস্টে অধিনায়ক হলেও নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এরইমধ্যে ২০২৩ সালের ৬ জুলাই আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ চলাকালীন চট্টগ্রামে হঠাৎ সংবাদ সম্মেলনে ডেকে তামিম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেন। জানিয়ে দেন, পরেরদিন আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচই তার ক্যারিয়ারে শেষ।’
এ নিয়ে নানা নাটক, তোলপাড়। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে তামিম অবসর ভেঙে ফেরার সিদ্ধান্ত জানান। তবে, চিকিৎসার জন্য চলে যান লন্ডনে। ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে দেশে ফিরে আসলে তাকে নিয়ে নানা জটিলতা শুরু হয়। তখনকার অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের সঙ্গে বিরোধ শেষ পর্যন্ত তামিমকে বিশ্বকাপের দল থেকেই বাদ দিয়ে দেয়।
এরপর থেকে গত প্রায় ২ বছর নানা টালবাহানা চলছিলো তামিমের ক্যারিয়ার নিয়ে। তিনি ফিরবেন কি ফিরবেন না, তা নিয়ে ছিল সন্দেহ-সংশয়। বিসিবির সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং, আলোচনা, শর্ত আরোপ। শেষ পর্যন্ত গত ১০ জানুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে তামিম জানিয়ে দিলেন, তিনি আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরবেন না। পূর্ণ অবসরে। তবে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে যাবেন।
অর্থ্যাৎ মাঠ থেকে নয়, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে অবসর ঘোষণা করলেন তিনি।
মুশফিকুর রহিম
বাংলাদেশ ক্রিকেটে মিস্টার ডিপেন্ডেবল হিসেবে পরিচিত মুশফিকুর রহিম কিছুটা আবেগিও বটে। ২০২২ বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে ক্রমাগত সমালোচনার শিকার হলে একই সালের ৪ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। জানিয়ে দেন, টি-টোয়েন্টি বাদ দিয়ে শুধু ওয়ানডে এবং টেস্টের প্রতি নিজের মনযোগ বাড়াতে চান।
কিন্তু মুশফিকের বিশেষ করে ওয়ানডেতে পারফরম্যান্সের উন্নতি হয়নি খুব একটা। এরপর ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলেছেন, নানা সিরিজে ওয়ানডে ও টেস্ট খেলেছেন। সর্বশেষ খেললেন আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি; কিন্তু বাজে ব্যাটিংয়ের কারণে তুমুল সমালোচনার শিকার হন মুশফিক।
শেষ পর্যন্ত গত ৫ মার্চ রাতে ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টের মাধ্যমে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে নিজের অবসরের কথা ঘোষণা করেন। এখানেও আবেগ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। খিলেছিলেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহ আমার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে এটাই আমার নিয়তি।’ অর্থ্যাৎ তুমুল সমালোচনার মুখে অবসরের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় ৩৮ বছর বয়সী এ ক্রিকেটার।
তবে এখনও টেস্ট চালিয়ে যাবেন তিনি এবং বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শততম টেস্ট খেলার দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। হয়তো শততম টেস্ট খেলার পর এই ফরম্যাটকেও বিদায় বলবেন। তখন কী ফেসবুকে পোস্ট করে নাকি আগে ঘোষণা দিয়ে মাঠ থেকে বিদায় নেবেন, সেটাও দেখার বিষয়।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ
২০২১ সালের জুলাইয়ে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ম্যাচের টেস্ট সিরিজ চলছিলো। ম্যাচের তৃতীয় দিন হঠাৎ ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ টেস্ট থেকে অবসরের কথা জানান। ম্যাচের পঞ্চমদিন সতীর্থরা মাহমুদউল্লাহকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। ওই ম্যাচটা ছিল তার ৫০তম টেস্ট এবং শেষ ম্যাচে ১৫০ রান করেন তিনি। যদিও তার এমন অবসর নিয়ে তখনকার বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন।
ওই বছর নভেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেন অর্থ্যাৎ টেস্টে অবসর ঘোষণা দিয়ে মাঠ থেকে বিদায় নেয়া হলো না তার।
শুধুমাত্র টি-টোয়েন্টিতে মাঠ থেকে বিদায় নিতে পেরেছিলেন মাহুমদউল্লাহ রিয়াদ। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির আগেরদিন ঘোষণা করেন, পরের ম্যাচটাই তার শেষ টি-টোয়েন্টি এবং খেলেই তিনি বিদায় নিয়েছিলেন এই ফরম্যাট থেকে।
ওয়ানডে খেলে গেলেও আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে একটিমাত্র ম্যাচ খেলার সুযোগ পান এবং খুব বাজেভাবে আউট হন। যে কারণে তুমুল সমালোচনার শিকার হন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১২ মার্চ ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে অবসরের ঘোষণা দেন মাহমুদউল্লাহ। অর্থ্যাৎ ঘোষণা দিয়ে মাঠ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলতে পারেননি তিনিও।
আইএইচএস/