নারী ও শিশু

হঠাৎ ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে কেন? কী করছে পুলিশ?

ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে মাগুরায় যৌন নির্যাতনের শিকার আট বছর বয়সী শিশুটি। তার জীবন সংকটাপন্ন। বুধবার (১২ মার্চ) একদিনে চারবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়েছে শিশুটি।

Advertisement

গত ৫ মার্চ রাতের এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে গোটা দেশের মানুষ। জড়িতদের শাস্তির দাবিতে রাজপথে চলছে আন্দোলন-সমাবেশ। চার আসামিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এরপরও থেমে নেই ধর্ষণ।

গত ৮ মার্চ রাতে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন অন্তঃসত্ত্বা এক নারী। পুলিশ জানায়, স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে ওই নারী কয়েক দিন আগে ঢাকায় আসেন। তিনি কাজ খুঁজছিলেন। ঢাকায় এসে একটি মাজারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাতে কেরানীগঞ্জে গেলে তিন অটোরিকশাচালক ওই নারীকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে একটি ঘরে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেন।

একই রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় ১৪ বছরের এক কিশোরীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নগ্ন ভিডিও ধারণ এবং পরে সেই ভিডিও দেখিয়ে ধর্ষণচেষ্টা করেন মেয়েটির সৎবাবা। রাতেই ওই ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে দেন স্থানীয় লোকজন। পরে তার বিরুদ্ধে বন্দর থানায় পর্নোগ্রাফি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা করেন ভুক্তভোগী কিশোরীর মা।

Advertisement

দেশে প্রতিদিন ১৩ জনের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ধর্ষণের ঘটনায় আসামি গ্রেফতার করতেও পুলিশ অনেক সময় অনীহা প্রকাশ করে। গ্রেফতার হলেও ভুক্তভোগীর পরিবারকে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে যান।

১০ মার্চ রাঙামাটি জেলা শহরে তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে সুভাষ কুমার চাকমা (৬০) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

রাঙামাটি জেলা শহরে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার সুভাষ কুমার চাকমা/জাগো নিউজ

ভুক্তভোগী শিশুর মা জানান, ৯ মার্চ রাতে শিশুটি তার দাদা-দাদির সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল। পরদিন সকালে তার দাদি তাদের বিছানায় রেখে কাজে বের হন। সকাল ৭টার দিকে মেয়েটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। পরে মেয়েটি তাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানায়। এ ঘটনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন শিশুটির মা।

Advertisement

আরও পড়ুন মাগুরায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশুকে সিএমএইচে নেওয়া হলো মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ৪ স্বামীর সঙ্গে রাগ করে ঢাকায় এসে ধর্ষণের শিকার অন্তঃসত্ত্বা

এছাড়া ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলায় চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে সাড়ে চার বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী শিশুর মা বাদী হয়ে হরিণাকুন্ডু থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় ১০ মার্চ বিকেলে ১৫ বছর বয়সী অভিযুক্ত কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

একই দিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় হাবিবুর রহমান হাবু (৪২) নামে একজনকে গ্রেফতার করে র‍্যাব-১১।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতার হাবিবুর রহমান হাবু/জাগো নিউজ

এসব ঘটনার মতো দেশে প্রতিদিন ১৩ জনের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ধর্ষণের ঘটনায় আসামি গ্রেফতার করতেও পুলিশ অনেক সময় অনীহা প্রকাশ করে। গ্রেফতার হলেও ভুক্তভোগীর পরিবারকে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে যান। জড়িতদের সঠিক বিচারের আওতায় আনা যায় না। ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা সমাজে গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। কেউ আবার আত্মহত্যার পথও বেছে নেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অজুহাতে শিশু ও নারী ধর্ষণ, নারীকে হেনস্তা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র দেশে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং তাদের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর বিচার কার্যক্রম অনেক দেরিতে হচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের সদস্যরা মানসিকভাবে সমাজের বোঝা মনে করছেন। দ্রুত বিচার করে ধর্ষককে জনসম্মুখে শাস্তি দেওয়া গেলে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে।

তিন বছরের জানুয়ারির মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৫৪টি, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৩০৮টি এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৩৯২টি।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ধর্ষণের মামলা বেশি

পুলিশ সদর দপ্তরের ধর্ষণ মামলার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের ঘটনায় ২০২৩ সালে মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার ১৯১টি। ২০২৪ সালে মামলা হয়েছে চার হাজার ৩৯৪টি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ মাসে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে নয় হাজার ৯৭৭টি। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এদিকে, ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে দায়ের করা ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তিন বছরের জানুয়ারির মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৫৪টি, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৩০৮টি এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৩৯২টি মামলা হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৩৪টি করে। চলতি বছর জানুয়ারিতে এক মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১টি।

গত ১২ মাসে বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ নারী নানান রকম সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ যৌন সহিংসতাজনিত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০২৪ সালে করা এক জরিপে উঠে এসেছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হন। গত ১২ মাসে বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ নারী নানান রকম সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ যৌন সহিংসতাজনিত।

গত দশকে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে যৌন সহিংসতার হার ছিল ২৭ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২৪ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ; শহরে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ ও গ্রামে ২৮ শতাংশ।

আরও পড়ুন রাঙ্গামাটিতে ৩ বছরের শিশুকে ধর্ষণ, দাদা গ্রেফতার মানিকগঞ্জে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে কিশোর গ্রেফতার মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে সারাদেশ

জরিপে বলা হয়েছে, সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে কখনো বলেননি। পরিবারের সুনাম রক্ষার আকাঙ্ক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ এবং এ ধরনের সহিংসতাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণ থেকে মূলত এই নীরবতা।

মাগুরায় আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে ৮ মার্চ রাতে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস/জাগো নিউজ

ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী, অর্থাৎ প্রতি আটজনে একজন নারী ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশে গত আট বছরে তিন হাজার ৪৩৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে ৯৩৩ জন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে তিন হাজার ৪৩৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে ৯৩৩ জন।

বলাৎকারের শিকার ছেলে শিশুরা

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২৪ সালেই ছেলে শিশু বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি আর বলাৎকারের চেষ্টা হয়েছে তিনটি।

অপরদিকে, ইউনিসেফ বলছে, সারা বিশ্বে হিসাব করলে এ সংখ্যা ২৪ থেকে ৩১ কোটি অর্থাৎ প্রতি ১১ জনে একটি ছেলে শিশু শৈশবে বলাৎকার বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, বলছিলেন এ খাত নিয়ে কাজ করা একাধিক অধিকারকর্মী। ছেলে শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও খুব কম ক্ষেত্রেই এ নিয়ে সচেতনতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সুবিধাবঞ্চিত বা বিপজ্জনক স্থানে থাকা শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে

২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা মহানগরের শিশুদের ওপর হওয়া যৌন সহিংসতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে শিশুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়। যেমন: শিশুদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নির্যাতনকারীর যৌনতৃপ্তি লাভ কিংবা নিজেকে নিয়ে পৌরুষযাচিত চিন্তা এক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এছাড়া শিশুর বাহ্যিক সৌন্দর্যও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শিশু কোন পরিবেশে থাকছে, সে বিষয়টিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। যেমন, সুবিধাবঞ্চিত বা বিপজ্জনক স্থানে থাকা শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একই কথা বলা হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রেও। দরিদ্রতার কারণে মা হয়তো বাসার বাইরে কাজ করতে চলে গেলেন, বাচ্চাকে বাসায় রেখে যেতে হলো- এরকম ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা ঘটে। আর দরিদ্রতার জন্য নিরাপত্তার অভাবও থাকে।

এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, বৈরী মনোভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্বসহ আরও কিছু বিষয়কে শিশু ধর্ষণের কারণ হিসেবে গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়।

ধর্ষণের ঘটনার পর ভুক্তভোগীর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ১০ বছর বয়সী এক মাদরাসা শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্থানীয় মাতবররা গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি ফিরোজ মিয়াকে চড়-থাপ্পড় আর দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয় সালিশে। জরিমানার ৯২ হাজার টাকা দিলেও ৫৮ হাজার বাকি রাখা হয়।

ভুক্তভোগী ওই শিশুর পরিবার জানায়, ভয়ে তারা মুখ খোলেনি। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে অভিযান চালায়।

যশোরের শার্শা উপজেলায় বাকপ্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে ধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর ভয়ভীতি দেখিয়ে গর্ভপাত ঘটায় ৬০ বছর বয়সী আবু তালেব। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ধর্ষণের পর কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তার বাবা-মা বিষয়টি স্থানীয় ব্যক্তিদের জানান এবং বিচার চান। স্থানীয় ব্যক্তিরা বিচার না করে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ওই কিশোরীর বাবা-মাকে ভয়ভীতি দেখান। পরে পল্লী চিকিৎসক দিয়ে ওই কিশোরীর গর্ভপাত করানো হয়।

আইনে কী আছে?

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

আরও পড়ুন ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি সোনারগাঁয়ে প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ, অভিযুক্ত গ্রেফতার ৯ বছরের শিশুকে ধর্ষণ, বৃদ্ধকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

যদি কোনো ব্যক্তি ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তাকে অতিরিক্ত অন্তত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হবে।

মাগুরায় আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে ৮ মার্চ রাতে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস/জাগো নিউজ

যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অন্তত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

‘দ্রুত বিচার আইনে বিচার করলে ধর্ষণের ঘটনা অনেক কমে যেত। কারণ এ অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা এক সময় বেড়ে গিয়েছিল, তখন যাবজ্জীবনসহ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা হয়। এরপর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমে আসে।’- সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের সভাপতি অধ্যাপক ইশরাত শামীম

ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে কেন?

দেশে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সীমা জহুর জাগো নিউজকে বলেন, আগে এত ইউটিউব-ফেসবুক ছিল না, ইদানীং এসব দেখে দেখে প্র্যাকটিস করতেছে কেউ কেউ। এছাড়া সামাজিক অবক্ষয়সহ ধর্মীয় অনুশাসন নেই। আমরা যতই স্বাধীনতা স্বাধীনতা করছি কিন্তু নিজের ঘরেই নারী-শিশুরা নিরাপদ নয়। ঘরের ভেতর নিরাপত্তা কে দেবে? এজন্য ধর্মীয় অনুশাসন দরকার।

নারী ও শিশুরা সব সময় ভিকটিম হয় উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, সেটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শুরু করে নিজের ঘর পর্যন্ত। একটি ধর্ষণের ঘটনা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা গেলে ধর্ষণ এমনিতেই কমে যাবে।

এছাড়া সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক যোগাযোগের কনটেন্টগুলো নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ অশ্লীল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, একটি ঘটনার পর কয়েক দিন খুব আলোচনা হয়, তারপর আবার আগের অবস্থা ফিরে আসে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও তা কার্যকরের নজির কম। শিশুদের প্রতিবাদ করার সক্ষমতা ও সাহস থাকে না, ফলে সহজ টার্গেট হয় তারা। যারা ধর্ষণের শিকার হয়, তারা ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও আইনি সুরক্ষা পান না। আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সামাজিক অনুশাসন ও আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের সভাপতি অধ্যাপক ইশরাত শামীম জাগো নিউজকে বলেন, বিচার, বিচার, বিচার। দ্রুত বিচার ছাড়া ধর্ষণ কমবে না। দ্রুত বিচার আইনে বিচার করলে ধর্ষণের ঘটনা অনেক কমে যেত। কারণ অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা এক সময় বেড়ে গিয়েছিল, তখন যাবজ্জীবনসহ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা হয়। এরপর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমে আসে। সমাজে এত ধর্ষক, তাদের খুঁজে বিচার করতে পারছি না কেন আমরা? ধর্ষকরা কি এতই প্রভাবশালী? মিডিয়া এত লিখছে কিন্তু তবু কমছে না। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ধর্ষকদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। বিচার হবে এক বছর ধরে, এটা মানুষ ভুলে যায়। এভাবে হবে না। দ্রুত বিচার আইন ছাড়া কোনো উপায় নেই।

আইনজীবী তামান্না তাসনিয়া তুয়া জাগো নিউজকে বলেন, নির্বাচিত সরকার না থাকায় বর্তমানে পুলিশ-প্রশাসন তৎপর নয়। ধর্ষণের ঘটনা আগেও ছিল। তবে তৃণমূল পর্যায়ে অনেকেই মামলা করতে চান না। দুর্বল শ্রেণির মানুষ মামলাকে হয়রানি কিংবা ভয় মনে করেন। আর যারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটান তারা প্রভাবশালী হলে টাকা-পয়সা দিয়ে সমঝোতা করেন। বর্তমানে অ্যালার্মিং হলো বাচ্চারা বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শিশু ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন ধর্ষণ-নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে খোলা হচ্ছে ‘হটলাইন’ ধর্ষণের শিকার শিশুর ৯৭ শতাংশ ছবি-ভিডিও অপসারণ: বিটিআরসি প্রশাসনের কর্তৃত্ব না থাকায় ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে : রিজভী

ধর্ষকদের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহান আরা হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে পরিস্থিতি! আমার বাচ্চাটাকেও বাইরে পাঠাতে ভয় করছে। দেশবাসীকে জানিয়ে একজন রেপিস্টকে যদি জনসম্মুখে সামরিক ট্রায়াল করে শাস্তি দেওয়া যায় তবেই ধর্ষণের মতো ঘটনা কমে আসবে। তাহলে বোঝা যাবে বিচার হয়। যারা ভুক্তভোগী তারা থানায় যেতে পারেন না, তাদের জন্য কোথাও কোনো স্পেস থাকে না। মামলা করলেও পরবর্তী সময়ে তারা কোনো সুফল পান না। তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখানো হয়।’

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী/জাগো নিউজ

প্রশাসনের কর্তৃত্ব না থাকায় ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে: রিজভী

প্রশাসনের কর্তৃত্ব না থাকায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। ১০ মার্চ নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত র‍্যালি ও সমাবেশে তিনি বলেন, শিশু বোনের বাড়িতে নিরাপদ নয়, তাহলে আর কোথায় নিরাপদ হবে? আজ ধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। নারীরা এখন নিরাপদ নয়। প্রশাসন যদি আগের ঘটনাগুলোর বিচার করতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটতো না। ১৫ বছর তো শেখ হাসিনা সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছেন। মানুষ নৈতিকতা শেখে পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। শেখ হাসিনা ১৫ পাঠ্যবইয়ে শুধু তার পিতা, মাতা, ভাই-বোনকে যুক্ত করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন।

জামিন না দিয়ে ধর্ষণের বিচার ৯০ দিনে

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গত ৯ মার্চ সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কিছু আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কিছুটা পরামর্শ করে, তারপর ফাইনালাইজ করবো। আমরা চেষ্টা করবো কয়েকদিনের মধ্যে আইনগত পরিবর্তন আনার জন্য।

গত ৯ মার্চ সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী/জাগো নিউজ

ব্যাখ্যা তুলে ধরে আফিস নজরুল বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা ৩০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে তাকে পরিবর্তন করায় মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক দেরি হয়ে যেত। আমরা ইনশাআল্লাহ যে সংশোধনী আনবো- সেখানে বলবো যাকে দেওয়া হয়েছে, নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাকে সম্পন্ন করতে হবে, তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা যাবে না। তদন্তের সময় অর্ধেক করে ১৫ দিন করে দিচ্ছি। বিচারের জন্য আগে যে সময় ছিল তা অর্ধেক করে দিচ্ছি, ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের মামলায় বিচার করতে হবে। ১৫ দিনে তদন্ত কাজ শেষ করতে হবে।

আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ না হলেও এ অজুহাতে কাউকে জামিন দেওয়া যাবে না। আগে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার না হলে জামিন দেওয়া যেত, এখন কোনো জামিন দেওয়া হবে না ধর্ষণের মামলায়।

জিরো টলারেন্স নীতি পুলিশের

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এনামুল হক সাগর জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ দমনের পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ পুলিশ অঙ্গীকারবদ্ধ। ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

আরও পড়ুন মাগুরার শিশু ধর্ষণের বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ ধর্ষণ মামলার বিচার ৯০ দিনে শেষ করতে হবে

তিনি বলেন, নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটূক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন (০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২,০১৩২০০০২২২২) সেবা চালু করেছে ইতোমধ্যে। দেশের যে কোনো স্থানে এমন ঘটনা ঘটলে এ হটলাইন নম্বরে অভিযোগ দেওয়া যাবে। এছাড়া সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের আইনি সেবা ও সুরক্ষা প্রদানে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ফেসবুক পেজেও অভিযোগ জানাতে পারবেন ভুক্তভোগীরা।

টিটি/এসএনআর/এমএমএআর/এএসএম