রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার ইউক্রেন আক্রমণ শুরু হয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে, যখন রুশ বাহিনী একাধিক দিক থেকে ইউক্রেনে আক্রমণ করে। এরপর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দিতে গিয়ে উল্লেখযোগ্য অর্থ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে, ইইউ পরিকল্পনা করছে ৯,০০০ বিলিয়ন ক্রোনার (৮১,৪৫০,০০০,০০০,০০০ বাংলাদেশি টাকা) প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে।
Advertisement
এই বিশাল পরিমাণ অর্থ দিয়ে ইউক্রেনের প্রতি সহযোগিতা নিশ্চিত করা এবং ইউরোপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেই এই বাজেট বরাদ্দ করা হবে। ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন জানিয়েছেন, ইউরোপ তার প্রতিরক্ষা ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়াতে প্রস্তুত।
বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস: অস্ত্রের পুরোনো ঐতিহ্য ও বর্তমান বাস্তবতাদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুইডেনসহ ইউরোপের বহু দেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করলেও, যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করেছিল। যুদ্ধের পর, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচুর চেষ্টা হলেও, সমরাস্ত্রের ব্যবসা অব্যাহত ছিল। আজকের দিনে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য বিশ্বশক্তি তাদের পুরোনো অস্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ইউক্রেনে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং যুদ্ধের এই পরিস্থিতি ক্রমাগত খরচ বৃদ্ধি করছে।
বর্তমানে, উন্নত দেশগুলো যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি করতে, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে এবং তাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করছে। পুরোনো অস্ত্রের সঙ্গে নতুন এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা)-ভিত্তিক অস্ত্র প্রযুক্তি তৈরির জন্য বিশাল বাজেট প্রয়োজন। আর এই অর্থের যোগান দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নও এর ব্যতিক্রম নয়।
Advertisement
উল্লেখযোগ্য, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের পুরোনো অস্ত্র ব্যবহার করছে, যার মধ্যে অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি ও অর্থের ব্যবহারের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে বিশ্বকে আরও গভীরভাবে বিনিয়োগ করতে হবে, কারণ এই প্রযুক্তিগুলো একদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্যদিকে মানবিক উন্নয়নের জন্যও এগুলোর ব্যবহার হতে পারে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে—বিশ্বের এই যুদ্ধের অস্ত্রগুলোর আড়ালে, মানুষের কল্যাণের জন্য কি আরও বড় বাজেট বরাদ্দ করা উচিত নয়?
মানবকল্যাণে বিনিয়োগের সম্ভাবনা: একটি নতুন পৃথিবী গড়ার আশাযতটা অর্থ বর্তমানে যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরির জন্য ব্যয় করা হচ্ছে, তা যদি মানব কল্যাণের জন্য ব্যয় করা হতো, তাহলে পৃথিবীটা অনেক বেশি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত হতে পারতো। যুদ্ধের এই বিশাল বাজেট যদি পৃথিবীর গরিব মানুষকে সাহায্য করার জন্য ব্যবহৃত হতো, তবে বহু সমস্যার সমাধান হতে পারতো—বিশেষ করে দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ সংরক্ষণে।
এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ২০২২ সালের পর থেকে আমরা দেখেছি কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়েছে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। কিন্তু এই সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য বর্তমান খরচের একটি বড় অংশ যুদ্ধ ও অস্ত্রের ওপর ব্যয় করা হচ্ছে।
বিশ্ব নেতাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজনএখন সময় এসেছে বিশ্ব নেতাদের কাছে নতুন চিন্তা করার। যেখানে বিশাল বাজেট যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি করতে ব্যয় হচ্ছে, সেখানে একই অর্থ মানব কল্যাণের জন্য ব্যয় করলে কি পৃথিবী অনেক ভালো জায়গা হতে পারতো না? এই অর্থ যদি খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সুরক্ষায় ব্যবহৃত হতো, তবে বিশ্ব খুব দ্রুতই তার অগ্রগতি এবং উন্নয়ন দেখতে পেত।
Advertisement
যতটা আমরা দুঃখজনকভাবে দেখতে পাচ্ছি, বহু মানুষ এখনও একঘেয়ে জীবনযাপন করছে, দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাচ্ছে, তবে সেই অর্থ যদি মানবকল্যাণের দিকে পরিচালিত হতো, তবে ভবিষ্যতের পৃথিবী এক নতুন দিগন্তে প্রবাহিত হতে পারতো।
মানবতা কি হারিয়ে যাচ্ছে?বিশ্বজুড়ে যেভাবে সামরিক বাজেট এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সেখানে একদিকে দাঁড়িয়ে, মানবকল্যাণের দিকে আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রশ্ন উঠতে পারে—এই বিপুল অর্থ কেন শুধু প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা হবে? যদি এই টাকা মানুষের উন্নতির জন্য ব্যয় করা হতো, তবে পৃথিবী আরও শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং মানবিক দৃষ্টিতে উন্নত হয়ে উঠত।
আরও পড়ুন ধর্ষণ ও সমাজের অবস্থান সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির দ্বিতীয় নিবাসযুদ্ধের অস্ত্র এবং এআই প্রযুক্তির বিকাশের পরিবর্তে, যদি এই বিশাল পরিমাণ অর্থ মানবকল্যাণের জন্য ব্যয় করা হতো, তাহলে আমাদের পৃথিবী এক নতুন দিগন্তে প্রবাহিত হতে পারত। তাই, যে অর্থ সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হচ্ছে, সেই অর্থ যদি মানবিক উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হতো, তবে পৃথিবী হয়তো এক মানবিক, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ স্থান হয়ে উঠত।
সামরিক খাতে বিশাল বাজেট বনাম মানবকল্যাণবর্তমানে চলমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং সামরিক বাজেটের বৃদ্ধি এটি প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আজকাল অস্ত্রের বাজারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু, আমরা কি কখনো ভেবেছি, এত বিশাল অর্থ যদি মানবকল্যাণে ব্যয় করা হতো, যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ, তাহলে পৃথিবী কেমন হতো? এসব গুরুত্বপূর্ণ খাতে এই অর্থ বিনিয়োগ করলে আমাদের পৃথিবী কি আরও শান্তিপূর্ণ, সুখী এবং সমৃদ্ধ হয়ে উঠত না?
সময় এখনই—কীভাবে আমরা পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারি?এখন সময় এসেছে, বিশ্ব নেতা এবং জনগণকে একযোগে ভাবতে হবে—এত বিপুল পরিমাণ অর্থ কেন যুদ্ধের জন্য ব্যয় করা হবে? কেন এই বাজেট মানবকল্যাণের জন্য ব্যবহার করা হবে না? যদি প্রতিরক্ষা খাতে এত বিশাল বাজেট বরাদ্দ করা যায়, তাহলে মানবিক উন্নয়ন খাতে সমানভাবে বাজেট বরাদ্দ করার সময় এসেছে।
আমাদের পৃথিবী এবং সমাজের উন্নতির জন্য এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।
এটি কি পৃথিবীকে আরও ভালো করতে পারবে?এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে—আমরা কি একটি নতুন পৃথিবী তৈরি করতে পারি, যেখানে বাজেট শুধু অস্ত্র তৈরি বা যুদ্ধের জন্য নয় বরং মানুষের জীবন, সুখ, শান্তি এবং কল্যাণের জন্য ব্যয় হবে? মানবতা কি সত্যিই হারিয়ে যাবে, নাকি আমাদের একত্রিত প্রচেষ্টায় আমরা পৃথিবীটিকে আরও ভালো, শান্তিপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হব?
সময় এসেছে মানবতার সঠিক দিকে এগিয়ে যাওয়ার। একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং সম্মিলিতভাবে ভবিষ্যতের পথ রচনা করা সম্ভব। এখন যদি আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেই, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ এবং মানবিক পৃথিবী রেখে যেতে পারবো।
এটা আমাদের সবার দায়িত্ব—যুদ্ধের বাজেট কমিয়ে মানবকল্যাণের দিকে অর্থের প্রবাহ তৈরি করা। পৃথিবী পরিবর্তন করতে হলে আমাদের এখনই সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন) Rahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস