নারী দিবসে বিশ্বজুড়ে নারীর অর্জন, সংগ্রাম, এবং অধিকারকে স্মরণ ও উদযাপন করা হয়। এই দিনটি শুধু নারীর সম্মানই প্রকাশ করে না, বরং সমাজে নারীর অবস্থান, তাদের ক্ষমতায়ন, এবং লৈঙ্গিক সমতার গুরুত্বকেও তুলে ধরে। নারীর সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে হয়তো রোজ ভাবেন না অনেকেই, তবে আজকের দিনে নারীকে আরেকটু বুঝতে আপনার ভালোবাসার মানুষগুলোর সঙ্গে দেখতে পারে নারীকে নিয়ে তৈরি করা ফিল্ম।
Advertisement
সিনেমা শুধু বিনোদনই দেয় না, বরং সমাজের নানা প্রেক্ষাপট, নারীর জীবন, সংগ্রাম, এবং সাফল্যকে ফুটিয়ে তোলে। জেনে নিন এমন কিছু সিনেমার কথা যা নারী দিবসের তাৎপর্যকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে। এই সিনেমাগুলো নারীর শক্তি, সাহস, এবং স্বপ্নকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাবে, যা এই বিশেষ দিনটিকে আরও অর্থবহ করে তুলবে।
১. হিডেন ফিগার্স (২০১৬): এই সিনেমায় তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকান নারী—ক্যাথরিন জনসন, ডরোথি ভ্যান ও মেরি জ্যাকসনের বাস্তব জীবনের সংগ্রাম ও সাফল্যকে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে নাসায় কাজ করার সময় তারা বর্ণবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ক্যাথরিনের গণিত দক্ষতা নাসার মহাকাশ মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, ডরোথি প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান সুপারভাইজার হন, আর মেরি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। এই ছবি নারীর ক্ষমতা, প্রতিভা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক অনবদ্য উদাহরণ।
২. লিটল উইমেন (২০১৯): এই সিনেমাটি একটি পরিবারের চার বোন—জো, মেগ, বেথ ও অ্যামির জীবন সংগ্রাম ও স্বপ্নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে, জো (সার্শা রোনান) একজন স্বাধীনচেতা লেখিকা, মেগ (এমা ওয়াটসন) সুখী গৃহিণী হতে চায়, বেথ (এলিজা স্ক্যানলেন) সঙ্গীতপ্রেমী, আর অ্যামি (ফ্লোরেন্স পিউ) শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তাদের ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব ও স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ছবিটি নারীর আত্মনির্ভরতা ও পরিবারের বন্ধনকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলে।
Advertisement
৩. দ্য কালার পার্পল (১৯৮৫): এটি সেলি হ্যারিসের জীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। প্রাথমিক ২০শ শতাব্দীর জর্জিয়ায়, সেলি তার সৎ বাবার দ্বারা নির্যাতিত ও ধর্ষিত হয় এবং জোরপূর্বক মিস্টার নামের এক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। তার জীবন দুঃখ ও অপমানের মধ্যে কাটে, কিন্তু শুগ এভেরি নামের এক গায়িকার সঙ্গে বন্ধুত্ব তাকে নতুন আশা দেয়। শুগের সাহায্যে সেলি তার হারানো আত্মসম্মান ফিরে পায়, মিস্টারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত তার বোন নেটি ও সন্তানদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়।
৪. সাফ্রাজেট (২০১৫): এটি একটি ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র, যা ১৯১২ সালের ব্রিটিশ নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনের সংগ্রামকে তুলে ধরে। মড ওয়াটস, এক তরুণ লন্ড্রি কর্মী, প্রথমে নীরব জীবনযাপন করে, কিন্তু ধীরে ধীরে নারী অধিকারের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। ছবিটি নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের জন্য লড়াইয়ের এক অনবদ্য চিত্র, যা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে।
৫. মিসেস আমেরিকা (২০২০): এটি একটি সিরিজ, যা ১৯৭০-এর দশকের নারীবাদী আন্দোলন ও সমান অধিকার সংশোধনী (ইআরএ) এর লড়াইকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ধারাবাহিকটি ফিলিস শ্ল্যাফলি (কেট ব্লানচেট) এর মাধ্যমে দেখানো হয়, যিনি ইআরএ-এর বিরোধী ছিলেন এবং নারীবাদী নেতৃত্বের মুখোমুখি হন, যেমন গ্লোরিয়া স্টেইনেম, বেটি ফ্রিডান ও শার্লি চিশলম। এটি নারীবাদ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে জটিল দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে।
৬. লাপাটা লেডিজ (২০২৩): এটি একটি ভারতীয় হিন্দি সিনেমা। ২০০১ সালে নিমরল প্রদেশের এক গ্রামে, কৃষক দীপাক তার নতুন বধূ ফুল কুমারিকে নিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করে। গভীর রাতে গোলযোগে দীপাক ভুল বধূকে নিয়ে নেমে যায়, আর ফুল অন্য গৃহস্থের সঙ্গে থেকে যায়।
Advertisement
৭. মিসেস (২০২৫): এই চলচ্চিত্রটি রিচার সংগ্রামের গল্প, একজন শিক্ষিত নৃত্যশিল্পী যাকে এক পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে বিয়ের জালে জড়িয়ে পড়তে হয়। নতুন বিবাহিত জীবনের মিষ্টি স্বপ্ন ভেঙে যায় যখন রান্নাঘরের কাজ, লিঙ্গবৈষম্য ও স্বামীর অবহেলা তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। তার স্বপ্ন, আবেগ ও স্বাধীনতা পদদলিত হয় পরিবারের পুরুষতান্ত্রিক নিয়মে। একদিন সব অন্যায় সহ্য করতে না পেরে রিচা বিদ্রোহ করে।
৮. কুইন (২০১৩): এই সিনেমাটি একজন নারীর আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতাকে খুঁজে পাওয়ার জার্নিটাকে তুলে ধরেছে। রানি (কঙ্গনা রানাওয়াত) একটি সাধারণ মেয়ে, যার বিয়ে ঠিক আগ মুহূর্তে ভেঙে যায়। হতাশায় ভরা রানি একা ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়, যেখানে সে নতুন মানুষ, নতুন সংস্কৃতি ও নিজেকে চেনে। প্রতিটি পদক্ষেপে সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তার ভয় ও সংস্কার কাটিয়ে।
৯. থাপ্পড় (২০২০): এই সিনেমাটি সমাজের লিঙ্গবৈষম্য ও সম্পর্কের জটিলতাকে তুলে ধরে। অমৃতা (তাপসী পান্নু) একজন আদর্শ গৃহিণী, যার জীবন একদিন উল্টে যায় যখন তার স্বামী তাকে প্রকাশ্যে এক থাপ্পড় মারে। এই এক চড়ই তার আত্মসম্মান ও স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। অমৃতা ধীরে ধীরে নিজেকে আবিষ্কার করে, সমাজের প্রচলিত নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে। এই সিনেমাটি নারীদের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার গুরুত্বকে ফুটিয়ে তোলে ও প্রতিটি দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে।
১০. মেরি কম (২০১৪): এটি একটি জীবনী। এক অসাধারণ জীবনসংগ্রামের গল্প। গল্পটি ভারতের কিংবদন্তি বক্সার মেরী কমের জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত এই ছবিতে দেখা যায়, মণিপুরের এক সাধারণ মেয়ে কীভাবে বিশ্বজয়ী বক্সারে পরিণত হয়। সংস্কার, দারিদ্র্য ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে মেরী কম তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেন। মাতৃত্ব ও ক্যারিয়ারের মধ্যে ভারসাম্য রেখে তিনি প্রমাণ করেন, ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায়ের কাছে কোনো বাধাই বড় নয়। এই ছবি প্রতিটি দর্শককে অনুপ্রাণিত করে, স্বপ্ন দেখতে ও লড়াই করতে শেখায়।
১১. মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে (২০২৩): এই সিনেমাটি একজন মায়ের অদম্য সাহস ও মাতৃত্বের শক্তিকে তুলে ধরে। ভারতীয় বাঙালি মা দেবিকা চ্যাটার্জি (রাণী মুখার্জি) নরওয়েতে তার সন্তানদের হারানোর যন্ত্রণা ভোগ করেন, যখন নরওয়ের শিশু কল্যাণ কর্তৃপক্ষ তার সন্তানদের দূরে নিয়ে যায়। সংস্কৃতি ও আইনের সংঘাতে, দেবিকা একক যুদ্ধে নামেন, বিশ্বজুড়ে মাতৃত্বের অধিকার ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এএমপি/এএসএম