নারী ও শিশু

প্রতিটি বাধাই উদ্যোক্তার বিকাশের একটি সুযোগ

রিভ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরিচালকদের একজন মন্নুজান নার্গিস। বর্তমানে তিনি রিভ গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ফ্যাশন ব্র্যান্ড লা রিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসিতে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে এমফিল সম্পন্ন করেছেন তিনি। কর্মজীবনের প্রথম দিকের দিনগুলোতে তিনি কিছুকাল বারডেম হাসপাতালে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন।

Advertisement

একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তার অভিজ্ঞতা এবং নানা চড়াই-উতরাই নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মোঃ সামিউর রহমান সাজ্জাদ।

জাগো নিউজ: পেশাজীবনে আপনি বহুজাতিক কোম্পানি, গবেষণা, প্রযুক্তি এবং ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছেন। এই অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?

মন্নুজান নার্গিস: ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম ফার্মাসিস্টের চাকরি দিয়ে, এখন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড লা রিভের প্রধান নির্বাহী। প্রায় ২৮ বছরের কর্মজীবনের প্রতিটি ধাপ আমাকে আজকের অবস্থানে আসতে সাহায্য করেছে। প্রথমে বহুজাতিক কোম্পানিতে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে কর্পোরেট শৃঙ্খলা, দল পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কৌশল শিখিয়েছে।

Advertisement

এরপর গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আমি বিশ্লেষণী দক্ষতা ও নতুন কিছু শেখার অভ্যাস গড়ে তুলেছি। প্রযুক্তির প্রতি আমার সবসময়ই আগ্রহ ছিল। কারণ আমি বিশ্বাস করি, এটি যেকোনো শিল্পকে বদলে দিতে পারে।

রিভ সফটের অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা আমাকে উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা ও সমস্যা সমাধানের বাস্তবসম্মত উপায় খুঁজতে শিখিয়েছে।

যখন আমি ফ্যাশন শিল্পে প্রবেশ করি, তখন এইসব অভিজ্ঞতা একসঙ্গে কাজে লাগিয়েছি। ফ্যাশন কেবল সৃজনশীলতার জায়গা নয়, এটি একটি গতিশীল শিল্প যেখানে পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটে। তাই আমি প্রযুক্তি ও ফ্যাশনের মিশ্রণে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছি।

সম্প্রতি লা রিভে এআই নির্ভর ভার্চুয়াল ট্রায়াল রুম চালু করা এর বড় উদাহরণ। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্রেতাদের জন্য কেনাকাটার অভিজ্ঞতা আরও সহজ ও আধুনিক করা হয়েছে।

Advertisement

এই ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে শেখায়, একজন উদ্যোক্তা হিসেবে শুধু প্রতিভা বা পরিশ্রম যথেষ্ট নয়, দূরদৃষ্টি থাকতে হয়, সঠিক সময়ে ঝুঁকি নিতে হয়, আর পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। ফ্যাশন শিল্পে কাজ করা আমার জন্য শুধু ব্যবসা নয়, বরং এটি এমন একটি জায়গা যেখানে আমি সৃজনশীলতা, প্রযুক্তি ও কর্পোরেট কৌশলকে একসঙ্গে মিলিয়ে কিছু নতুন তৈরি করতে পারছি।

আরও পড়ুন নারীরা শক্তি, সাহস আর সম্ভাবনার প্রতীক নারীরা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে না, সুযোগ সৃষ্টি করবে

জাগো নিউজ: একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি কি কখনও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন?

মন্নুজান নার্গিসঃ লা রিভ শুরু থেকেই একটি কর্পোরেট কাঠামোর মধ্যে গড়ে উঠেছে, যেখানে আমি মূলত একজন ব্যবসায়ীর অ্যাপ্রোচে কাজ করেছি। ব্যবসায়ীদের জন্য চ্যালেঞ্জ থাকবেই, আর আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না।

আমি মনে করি, আমরা জীবনের যে ক্ষেত্রেই থাকি- চাকরিতে, ব্যবসায়, কিংবা ঘরে, চ্যালেঞ্জ আসবেই। আমি সবসময় সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে যৌক্তিকভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেছি এবং ইতিবাচক মনোভাব ধরে রেখেছি।

তাই আমি এটা সরাসরি বলতে পারবো না যে, আমি বৈষম্যের শিকার হয়েছি। বরং, আমি এটিকে একজন উদ্যোক্তার পথের স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেছি। যে কেউ এর সম্মুখীন হতে পারে যখন সে তার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। আমার বিশ্বাস, সফল হতে হলে এসব বাধাকে সমস্যা হিসেবে না দেখে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ হিসেবেই গ্রহণ করা উচিত।

জাগো নিউজ: আপনি কি মনে করেন বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন?

মন্নুজান নার্গিস: আমি মনে করি বাংলাদেশে নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে প্রতিদিনই আরও বেশি সচেতন হচ্ছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ক্রীড়াঙ্গন, কর্মসংস্থান এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নারীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

তবে, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে সমাজে এখনও বিভক্তি রয়েছে। পাশাপাশি, আমাদের দীর্ঘদিন ধরে লালিত অভ্যাসের কারণে পুরুষরা এখনো নারী নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে পারেননি। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত ও উদ্যমী নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠছেন, যা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করছে।

তবে, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও নিরাপত্তা সংকট এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। শুরু থেকেই আমাদের নারীরা অনেক পিছিয়ে ছিলেন। তাদের অধিকার রক্ষায় সবার ইতিবাচক সমর্থনের কোনো বিকল্প আমি দেখি না।

জাগো নিউজ: সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার চালিকাশক্তি কী বলে আপনি মনে করেন?

মন্নুজান নার্গিস: বাংলাদেশের নারীরা সমাজ ও দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, যা সত্যিই অনুপ্রেরণা দেয়। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, নগরায়ণের এই যুগেও বিশ্বের কৃষিপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে কাজ করছেন। যা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাচ্ছে। তবে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে নারীদের অংশগ্রহণ এখনও তুলনামূলক কম- মাত্র ৭ দশমিক ২১ শতাংশ। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে ব্যাংকগুলো নারীদের জন্য অর্থায়নের ক্ষেত্রে এখনও খুবই সীমিত ভূমিকা পালন করছে, যা মোট অর্থায়নের মাত্র ২৩ শতাংশ।

আমার অভিজ্ঞতায়, এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও নারীদের আত্মবিশ্বাস, দক্ষতা এবং উপযুক্ত পরিবেশ ও সমর্থন তাদের এগিয়ে যাওয়ার মূল চালিকাশক্তি। প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল লিটারেসি নারীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, যা তাদের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখছে। পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং নীতিনির্ধারকদের সহায়তা নারীদের এই অগ্রযাত্রাকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে বলে আমি মনে করি।

জাগো নিউজ: কর্মক্ষেত্রে নারীরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়? এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের করণীয় কী?

মন্নুজান নার্গিস: লা রিভে আমরা বিশ্বাস করি সাফল্যের মাপকাঠি হওয়া উচিত প্রতিভা, লিঙ্গ নয়। দুর্ভাগ্যবশত, এই মনোভাব এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানের পলিসিতেই নেই।

বাংলাদেশে নারীরা কর্মসংস্থানে এগিয়ে গেলেও এখনো লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, অসম পারিশ্রমিক, কর্মস্থলে হয়রানি, প্রযুক্তিগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা এবং কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনের ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবশ্যই সমান সুযোগ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং নারীদের ডিসিশন মেকিংয়ে এগিয়ে আসার পথ তৈরি করা উচিত।

বিশেষ করে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে নারীদের আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা জরুরি। কারণ ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রে ডিজিটাল লিটারেসি অপরিহার্য। এই পরিবর্তনের সময় এখনই।

জাগো নিউজ: তরুণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কিছু বলুন।

মন্নুজান নার্গিস: আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি নারী নিজ মহিমায় বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। এজন্য প্রয়োজন নিজের স্বপ্ন অনুসরণ করার সাহস ও নিজের জীবন কেমন হবে তা নিজেই নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করার আত্মবিশ্বাস।

যারা তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন বা কাজ করার স্বপ্ন দেখছেন, তাদের আমি বলবো যে, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন এবং আপনার স্বপ্নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন। এই যাত্রা কঠিন হতে পারে, কিন্তু প্রতিটি বাধাই বিকাশের একটি সুযোগ।

মনোযোগ ধরে রাখুন, নতুন কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যান, কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকুন এবং হতাশ হবেন না। সৃজনশীলতাকে আপন করে, নিজস্ব মূল্যবোধে অটল থেকে এবং সকল বাধা অতিক্রম করার মাধ্যমেই সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি নারীবান্ধব ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব।

এসআরএস/এএমএ/এমএমএআর/এএসএম