নারী ও শিশু

অন্য উদ্যোক্তাদের নকল না করে নিজের সম্ভাবনা খুঁজতে হবে

‘গ্রো ইয়োর রিডার’ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাদিয়া জাফরিন খান। শিশুদের বৃহত্তর কল্যাণে কীভাবে শিক্ষা কৌশল ব্যবহার করতে হয় তার অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন তিনি। প্রান্তিক শিশুদের জন্য তার শিক্ষামূলক উদ্যোগ বেশ প্রশংসিত।

Advertisement

শিক্ষায় শীর্ষ ১০০ নেতার পুরস্কার পেয়েছেন সাদিয়া জাফরিন খান। শিক্ষা, নারীর এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু।

জাগো নিউজ: শিক্ষাখাতের মতো চ্যালেঞ্জিং ও বহুমাত্রিক কাজ নিয়ে কাজ করার আগ্রহটা এলো কীভাবে?

সাদিয়া জাফরীন খান: দীর্ঘদিন ধরেই আমি পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে কাজ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ‘টিচ ফর বাংলাদেশ’-এ ফেলোশিপের কাজ শুরু করি। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই বছর পড়াই। তখন মনে হলো পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজটা কেবল শুরু হয়েছে। তারপর থেকে ‘গ্রো ইয়োর রিডার’ ফাউন্ডেশন নিয়ে কাজ শুরু করি।

Advertisement

আমাদের শিক্ষাখাত যদি পিছিয়ে যায়, দেশ এগোবে না। দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু এখন বাংলা পড়তে পারে না। কোভিডের পর স্কুল বন্ধ থাকায় এই হার আরও বেড়েছে। আমরা এখন পড়ার দক্ষতা বাড়ানো, পড়ার অভ্যাস তৈরি ও পড়ার সুযোগ তৈরি করা নিয়ে কাজ করছি।

আমি দেখলাম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত অনেক বেশি। শ্রেণিকক্ষে ৬০-৭০, কখনো ১০০ জন শিক্ষার্থীও থাকে। একজন শিক্ষকের পক্ষে এত বেশি শিক্ষার্থীকে সঠিক পাঠদান করা একেবারে অসম্ভব। ফলে অনেক শিশু তাদের যে ন্যূনতম দক্ষতা থাকা দরকার সেটাও অর্জন করতে পারছে না। কিন্তু তারা পরবর্তী শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে। একসময় তারা মাধ্যমিক পরীক্ষাও পাস করে ফেলছে।

শিক্ষার্থীরা এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উন্নীত হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তারা গুণগত শিক্ষাটা পাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। শতভাগ শিশু মৌলিক শিক্ষা পাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত শেখাটা হচ্ছে না। স্কুলে ভর্তি হওয়া বা নিয়মিত যাওয়া ও শেখা দুটো আলাদা বিষয়। ফেলোশিপের পর দেখলাম শিক্ষাখাতে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। এখানে আরও অনেক মানুষের এগিয়ে আসা উচিত।

আরও পড়ুন নারী উদ্যোক্তা তৈরির ‘উদ্যোক্তা’ ফাহমিদা নিজাম নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যে নারীরাই বেশি আগ্রহী নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ: ক্রমবর্ধমান সামাজিক সংকট

আমাদের শিক্ষাখাত যদি পিছিয়ে যায়, দেশ এগোবে না। দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু এখন বাংলা পড়তে পারে না। কোভিডের পর স্কুল বন্ধ থাকায় এই হার আরও বেড়েছে। আমরা এখন পড়ার দক্ষতা বাড়ানো, পড়ার অভ্যাস তৈরি ও পড়ার সুযোগ তৈরি করা নিয়ে কাজ করছি।

Advertisement

জাগো নিউজ: পথচলা কীভাবে শুরু হলো? উদ্যোক্তার জীবন কেন বেছে নিলেন?

সাদিয়া জাফরীন খান: বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার সময় আমি থিয়েটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। সেখানে আমার সাংগঠনিক দক্ষতা গড়ে ওঠে। আমার মধ্যেও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে এটা বুঝতে পারি। ফেলোশিপের সময় বুঝতে পারি শিক্ষকতাটা আমি ভালো পারি।

জাগো নিউজ: আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলুন? আপনারা কী ধরনের কাজ করেন?

সাদিয়া জাফরীন খান: আমরা একটি ননপ্রফিটেবল অর্গানাইজেশন। বর্তমানে ৫০ হাজার মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দিতে পেরেছি। পড়ার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আমাদের নিজস্ব কারিকুলাম আছে। যেটার নাম রিডিং সিক্রেটস। এর মাধ্যমে একটি শিশুর পড়ার দক্ষতা বাড়ে। শিশুর অভিভাবকরা এটি গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া আমাদের বিভিন্ন ধরনের লাইব্রেরি আছে। আমাদের পথ লাইব্রেরি, মোবাইল লাইব্রেরি, অনলাইন লাইব্রেরি আছে। এসব লাইব্রেরি থেকে যে কেউ বই সংগ্রহ করতে পারেন। আমাদের আফটার স্কুল প্রোগ্রাম আছে। যেখানে শিশুরা মৌলক অক্ষরজ্ঞান শিখছে।

একজন নারী ব্যবসা করবে, সেখানে তার ব্যবসায় কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। কেউ যখন বিনিয়োগ করে সে কিন্তু ব্যবসার ওপর নয়, উদ্যোক্তার ওপর বিনিয়োগটা করে। যখন মেয়ে ও ছেলের ব্যাপারটা চলে আসে, তখন ঝুঁকির বিষয়টা চলে আসে।

ময়মনসিংহে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ঈদের পর শুরু হবে। এছাড়া পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কমিউনিটি আছে। যেখানে যে কোনো বয়সের মানুষ একই সঙ্গে বসে বই পড়ি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি।

জাগো নিউজ: একজন উদোক্তা হিসেবে কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? পরিবারের সাপোর্ট কেমন ছিল?

সাদিয়া জাফরীন খান: উচ্চশিক্ষার পর যখন ‘টিচ ফর বাংলাদেশ’ শুরু করতে যাই তখন পরিবারের অনেকেই খুশি ছিলেন না। বিয়ের পর আমার স্বামীর কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি।

জাগো নিউজ: ২০২৫ সালে এসে নারীদের জন্য কী ধরনের বৈষম্য দেখছেন?

সাদিয়া জাফরীন খান: নারীদের ওপর বৈষম্য সব সময় ছিল। মোরাল পুলিশিং শুরু হয়েছে। দেশের জিডিপি বেড়েছে, অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চিন্তাভাবনার জায়গায় উন্নয়নের অনেক সুযোগ আছে। বিশেষ করে নারীর প্রতি মানুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে অনেক উন্নতি করতে হবে।

জাগো নিউজ: দেশে ই-কমার্সভিত্তিক বা অনলাইনভিত্তিক বেশিরভাগ নারী উদ্যোগ বড় হচ্ছে না কেন? 

সাদিয়া জাফরীন খান: অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পরিবার থেকে পুরোপুরি সহযোগিতা পায় না। একজন নারী ব্যবসা করবে, সেখানে তার ব্যবসায় কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। কেউ যখন বিনিয়োগ করে সে কিন্তু ব্যবসার ওপর নয়, উদ্যোক্তার ওপর বিনিয়োগটা করে। যখন মেয়ে ও ছেলের ব্যাপারটা চলে আসে, তখন ঝুঁকির বিষয়টা চলে আসে। একজন নারীর ওপর বিনিয়োগ করতে চায় না। মেয়ের বিয়ে হবে, সে সন্তান পালন করবে। এরকম বিভিন্ন জিনিস সামনে চলে আসে। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে একজন নারীর ব্যবসায় বিনিয়োগ করার চিন্তাভাবনা করেন বিনিয়োগকারী।

মূলধন যদি ব্যাংক বা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাওয়া না যায়; এখন হয়তো অনেক ব্যাংক নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু সরকার যদি আরও ব্যাপকভাবে কাজ করতো, এগিয়ে আসতো তাহলে নারীর উদ্যোগ আরও বেশি গতি পেতো। জাগো নিউজ: ব্যাংকঝণ, লাইসেন্স নিতে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আপনি এমন কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?

সাদিয়া জাফরীন খান: ব্যাংকঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম-কানুন আছে। আমার মনে হয় সেগুলো আরও সহজ করা দরকার আছে। কর, মূসক, সুদ- এগুলো যদি নারীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সহজ করা যেত এবং রেজিস্ট্রেশনটা যদি আরও বেশি সহজ হতো তাহলে ভালো হতো।

নারীদের ভেতর থেকে যদি নেতৃত্ব তুলে নিয়ে না আসি, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো নারী আসবে না। নারীদের রাস্তাটা সহজ করতে হবে। সব সেক্টরে নারীদের কীভাবে নেতৃত্বে আনতে পারি সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।

জাগো নিউজ: নারীদের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে সরকার কী উদ্যোগ নিতে পারে?

সাদিয়া জাফরীন খান: ব্যাংকঋণ সহজ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। কেবল সরকারি নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীদের ক্যারিয়ার গ্রোথ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থেমে যায়। এগুলো নিয়ে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। নারীদের ভেতর থেকে যদি নেতৃত্ব তুলে নিয়ে না আসি, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো নারী আসবে না। নারীদের রাস্তাটা সহজ করতে হবে। সব সেক্টরে নারীদের কীভাবে নেতৃত্বে আনতে পারি সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।

জাগো নিউজ: নারীদের জন্য কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন?

সাদিয়া জাফরীন খান: কেবল নারীদের জন্য নয়, সবার জন্য এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে সবাই তার মর্যাদাটা সমানভাবে পাবে। নারী-পুরুষ না বলে মানুষের মর্যাদা মানুষকে দিতে পারলে সুনাগরিক গড়ে উঠবে। জাগো নিউজ: বাইরে কতটা নিরাপদ মনে করেন নিজেকে?

সাদিয়া জাফরীন খান: একজন মেয়ে রাস্তা-ঘাটে শতভাগ নিরাপদ মনে করে কি না সন্দেহ আছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, ফাঁকা রাস্তা বা দোকানে একটা মেয়ে একা একা যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।

জাগো নিউজ: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

সাদিয়া জাফরীন খান: এখন স্টার্টাপের জন্য অনেক ভালো সময় যাচ্ছে। অন্য উদ্যোক্তারা কী করছে সেটা নকল না করে নিজের সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে হবে। কোন কোন জায়গায় সুযোগ আছে, কী ধরনের সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান খুঁজে বের করা। এই সমাধান নিয়ে যদি ভালোভাবে কাজ করা যায় তাহলে উদ্যোক্তা সামনে এগিয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।সাদিয়া জাফরীন খান: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।

এসএম/এএসএ/এএসএম