• সচিব পদে আছেন ১৩ জন নারী• নারী ডিসি ১৮ জন
Advertisement
প্রশাসনে সচিব ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বর্তমানে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী কর্মকর্তা কাজ করছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রশাসনে বর্তমানে ১৩ জন সচিব/সিনিয়র সচিব রয়েছেন নারী, এসব পদে মোট কর্মকর্তা ৭৭ জন। ৬৪ জেলায় ডিসি পদে নারী ১৮ জন। প্রশাসনের এ দুটি নীতি-নির্ধারণী পদে বিগত সময়ের মধ্যে এটিই নারীদের সর্বোচ্চ সংখ্যা বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা জানান, প্রশাসনে নারী তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষ কর্মকর্তার চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল, কাজে আন্তরিক ও সৎ। নারীদের আরও বেশি সংখ্যক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আসা উচিত।
মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে নারী সিনিয়র সচিব/সচিবের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। নারী ডিসির সংখ্যাও সীমাবদ্ধ ছিল ৮-১২ জনের মধ্যে।
Advertisement
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগের চরম দলীয় প্রশাসনকে পাল্টে দিতে খড়্গহস্ত ছিল এ সরকার। অধিকাংশ শীর্ষ কর্মকর্তাকে ওএসডি কিংবা বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়েছে। যদিও নারী সচিবদের বেশিরভাগ এখনো দায়িত্ব পালন করছেন, যা প্রশাসনে নারীদের অনন্য ভূমিকার দৃষ্টান্ত মনে করছেন প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা।
আমি কিশোরগঞ্জের প্রথম নারী জেলা প্রশাসক। আমার অবস্থাটা বুঝুন, কিন্তু এখানকার জনগণ আমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তাতে আমি আভিভূত। তাদের প্রতিক্রিয়া আমাকে কাজ করতে আরও উৎসাহিত করে।– কিশোরগঞ্জের ডিসি ফৌজিয়া খান।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্প্রতি প্রশাসনে নারীদের উপস্থিতি প্রশংসার যোগ্য। প্রশাসনের বাইরেও নারীরা তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। এটি অব্যাহত রেখে নারীকে আরও এগিয়ে যেতে হবে।’
প্রশাসনে নারীদের অবস্থানের বিষয়ে সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘নারী কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আমার ইম্প্রেশন (উপলব্ধি) খুবই ভালো, যারা আমার সঙ্গে চাকরি করেছেন তাদের অনেকেই ছেলেদের চেয়ে বেশি দায়িত্ববান, ইন্টিগ্রিটিও (ন্যায়পরায়ণতা) বেটার ছিল।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘দু-একজন যে অন্যরকম নেই তাও না। সার্বিকভাবে আমি বলবো তারা ভালোভাবেই তাদের যোগ্যতার সাক্ষর রাখছে। নারীদের আরও বেশি বেশি করে প্রশাসনে আসা দরকার বলে আমি মনে করি।’
আরও পড়ুন১০ মন্ত্রণালয়-বিভাগে নারী সচিব, নারী ডিসি ৭ জন‘প্রশাসনে নীতি-নির্ধারণী পদের যোগ্য অনেক নারী কর্মকর্তা আছেন’জামালপুর প্রশাসনে নারীর জয়জয়কারসাবেক এ সচিব আরও বলেন, ‘১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচে প্রথম একজন নারী এলো। পাকিস্তান আমলে মেয়েরা পুলিশ ও প্রশাসন- এ দুটি ক্ষেত্রে অযোগ্য ছিল। এ দুটি চ্যালেঞ্জিং জব, তাই তাদের আবেদন করতে দেওয়া হতো না। ভারতে দরখাস্ত করার সুযোগ ছিল, কিন্তু তার অনেক পরে মেয়েরা এসেছে। বাংলাদেশে ১৯৮২ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে আসতে থাকলো।’
সম্প্রতি প্রশাসনে নারীদের উপস্থিতি প্রশংসার যোগ্য। প্রশাসনের বাইরেও নারীরা তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। এটি অব্যাহত রেখে নারীকে আরও এগিয়ে যেতে হবে।- মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সবশেষ ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে মোট নারীর সংখ্যা ৪ লাখ ৯ হাজার ১৩৯ জন।
নারীদের মধ্যে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে (১ থকে ৯তম গ্রেড) কর্মরত ৪০ হাজার ১৮ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে (১০ থেকে ১২তম গ্রেড) ৬৬ হাজার ৫৮ জন। সবচেয়ে বেশি নারী রয়েছেন তৃতীয় শ্রেণির (১৩ থেকে ১৬তম গ্রেড) সরকারি চাকরিতে এ স্তরে নারীর সংখ্যা দুই লাখ ৪৭ হাজার ১৬২ জন। চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে (১৭ থেকে ২০তম গ্রেড) নারীর সংখ্যা ৫৫ হাজার ৮৭ জন।
বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক
১৮ নারী ডিসিমাঠ প্রশাসনে বর্তমানে ১৮ জন ডিসি জেলা সামলাচ্ছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন- চট্টগ্রামে ফরিদা খানম, বান্দরবানে শামীম আরা রিনি, বগুড়ায় হোসনা আফরোজা, রাজশাহীতে আফিয়া আখতার, নাটোরে আসমা শাহীন, জয়পুরহাটে আফরোজা আক্তার চৌধুরী, মেহেরপুরে সিফাত মেহনাজ ও নড়াইলে শারমিন আক্তার জাহান।
এছাড়া রয়েছেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন, টাঙ্গাইলে শরীফা হক, কিশোরগঞ্জে ফৌজিয়া খান, মুন্সিগঞ্জে ফাতেমা তুল জান্নাত, রাজবাড়ীতে সুলতানা আক্তার, মাদারীপুরে মোছা. ইয়াসমিন আক্তার, ঠাকুরগাঁওয়ে ইশরাত ফারজানা, কুড়িগ্রামে নুসরাত সুলতানা, জামালপুরে হাছিনা বেগম এবং নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্তরিকতা দিয়ে আমরা দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। নারীরা কাজে সর্বোচ্চ সময় দেয়। নারী বা পুরুষ নয়, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমরা জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
নারী কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আমার ইম্প্রেশন (উপলব্ধি) খুবই ভালো, যারা আমার সঙ্গে চাকরি করেছেন তাদের অনেকেই ছেলেদের চেয়ে বেশি দায়িত্ববান, ইন্টিগ্রিটিও (ন্যায়পরায়ণতা) বেটার ছিল।-সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার
তিনি বলেন, ‘ডিসি হিসেবে নারীদের বিষয়ে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। একটা সময় তো জেলা প্রশাসক হিসেবে নারী ছিলই না। এখন ধাপে ধাপে আসছেন। নারী হিসেবে কাজ করতে গেলে আগে যে ধরনের সমস্যাগুলো হতো এখন তা অনেকাংশে কমেছে। মানুষ এখন নারী জেলা প্রশাসকদের বিষয়ে ইতিবাচক। জেলা প্রশাসক এখন জনগণের আস্থার জায়গা।’
‘নারীরা তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করছে বলেই আজ ১৮ জন নারী জেলা প্রশাসক। নারীরা তাদের যোগ্যতায় এ জায়গায় এসেছে।’
‘আমি কিশোরগঞ্জের প্রথম নারী জেলা প্রশাসক। আমার অবস্থাটা বুঝুন, কিন্তু এখানকার জনগণ আমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তাতে আমি আভিভূত। তাদের প্রতিক্রিয়া আমাকে কাজ করতে আরও উৎসাহিত করে’ বলেন ফৌজিয়া খান।
বগুড়ার ডিসি হোসনা আফরোজা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাঠে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা এখন আর আগের মতো নানা বাধার মুখে পড়ি না। নারী ডিসিরাও পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে কি না- সেই মূল্যায়নটা আপনারা করবেন। আমরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ) মোহাম্মদ খালেদ রহীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে নারীরা ভালো করছেন। তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। নারী নয়, অফিসার হিসেবেই তারা ভালো কাজ করছেন।’
নারী সচিব ১৩ জনমহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সচিব) নাসরীন আফরোজ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ।
এছাড়া রয়েছেন- তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবা ফারজানা, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) কাইয়ুম আরা বেগম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) জাহেদা পারভীন, সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
প্রশাসনের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী স্তর সচিব পদে প্রথম নারী নিয়োগ পান ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। পরের বছর আরও একজন নারী সচিব হন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করা সচিব
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক বিষয় নিজের ওপরও নির্ভর করে। আমি কতটুকু অ্যাকোমোডেটেড, আমি কতটুকু মানুষকে সহযোগিতা করতে চাই। আমরা নিজের ওপর নির্ভর করবে অন্যদের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক কী হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন নারীরা শীর্ষ পদগুলোতে যাচ্ছে, তাদের কেউ নারী হিসেবে এ পদ দিয়েছে সেটা কিন্তু নয়। নারীরা নিজেদের যোগ্যতা দিয়েই এ সব পদে আসছেন বলে আমি মনে করি। যে কোনো দায়িত্ব দিলে নারী পারে, সেটা প্রমাণিত বলেই সরকার নারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসাচ্ছে।’
‘সততার ক্ষেত্রে নারীরা যে খুব কমই আপস করে এটা সম্প্রতি প্রমাণিত হয়েছে। নারীদের দিয়ে অনৈতিক কিছু করিয়ে নেওয়া অতো সহজ নয়’ বলেন ইসরাত চৌধুরী।
বিগত বছরগুলোতে নারী ডিসি-সচিবের সংখ্যা২০১৯ সালের মার্চ মাসে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব, সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিব ছিলেন ৭৮ জন। এর মধ্যে নারী কর্মকর্তা ছিলেন ছয়জন। নারীদের হার ছিল প্রায় ৮ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চে সচিব পদে ১০ জন নারী ছিলেন। এছাড়া মাঠ প্রশাসনে ছিলেন আটজন নারী জেলা প্রশাসক।
২০২১ সালে ৭৬ জন সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার মধ্যে নারী কর্মকর্তা ছিলেন ১০ জন। মাঠ প্রশাসনে ৬৪ জেলা প্রশাসকের মধ্যে নারী ছিলেন ১০ জন। ২০২২ সালে মার্চ মাসে ১২ জন সচিব কর্মরত ছিলেন, ডিসি ছিলেন আটজন।
২০২৩ সালের এ সময়ে সিনিয়র সচিব, সচিব ও সমপদমর্যাদার ৮৫ জন কর্মকর্তার মধ্যে নারী ছিলেন ১০ জন। একই সঙ্গে ৬৪টি জেলার মধ্যে ১০ জন নারী জেলা প্রশাসক ছিলেন।
২০২৪ সালে ৮৬ জন সচিব, সিনিয়র সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার মধ্যে নারী ছিলেন ১০ জন। ৬৪ জন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মধ্যে নারী ছিলেন সাতজন।
আরএমএম/এএসএ/জেআইএম