ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা। চোখ পড়লো টিনের ছাউনি দেওয়া একটি পুরোনো দোকানে। রোজা রেখে রোদের মধ্যেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকে। তবে আশপাশের দোকানগুলোতে নেই এমন চিত্র। সামনে এগিয়ে গিয়ে কারণ জানা গেলো। মূলত জিলাপি কিনতে মানুষ ওই দোকানে ভিড় জমিয়েছে।
Advertisement
এটি ময়মনসিংহ শহরের জিলা স্কুল মোড়ে অবস্থিত ‘মেহেরবান’ হোটেলের চিত্র। দুপুরে অন্য দোকানগুলোর বিক্রেতারা জিলাপিসহ ইফতারসামগ্রী ভাজতে আর ডালায় সাজাতে ব্যস্ত থাকলেও ‘মেহেরবান’ হোটেলে তখন বিক্রির ধুম পড়েছে।
এর কারণ, এই জিলাপির স্বাদ আলাদা। টক-মিষ্টি স্বাদের ছোট্ট আকারের এই জিলাপি একবার যিনি খেয়েছেন বারবার খেতে দোকানে আসেন। ঐতিহ্যবাহী এই জিলাপির কারিগর জাকির হোসেন। তিন যুগ ধরে সুস্বাদু এই জিলাপির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তিনি।
সোমবার (৩ মার্চ) দুপুরে দোকানে গিয়ে দেখা যায়, জিলাপি কিনতে শুধু যে শহরের লোকজন এসেছেন তা নয়। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে টক-মিষ্টি স্বাদের জিলাপির স্বাদ নিতে অনেকে এসেছেন। জেলার বাইরে থেকে কোনো কাজে এসেছিলেন, এমন অনেক ব্যক্তিও জিলাপি কিনে নিচ্ছেন। ঐতিহ্যের কারণে দোকানে বেচাকেনার ধুম পড়েছে।
Advertisement
প্রথম যেদিন জাকির হোসেন জিলাপি বানিয়েছিলেন, তখন ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে উপকরণের দাম। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে বিখ্যাত এই জিলাপির দামও। বর্তমানে টক-মিষ্টি জিলাপি ২২০, আমৃত্তি টক-মিষ্টি জিলাপি ২৬০ ও ঘিয়ে ভাজা স্পেশাল টক-মিষ্টি জিলাপি ৩৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ইফতারি হিসেবে বেগুনি ১০, আলুর চপ ১০, ডিম চপ ১০, চিকেন চপ ২০, শাকের বড়া ৫ টাকা পিস ও পিয়াজু ৫ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া নিমকি ২৪০, বুন্দিয়া ২০০, ছোলা বুট ২০০ ও ঘুগনি ১৬০ কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: সিলেটিদের ইফতারে ‘পাতলা খিচুড়ি’ থাকা চাই-ই চাইস্থানীয়রা জানান, সময়ের ব্যবধানে শহরজুড়ে বহু জিলাপির দোকান গড়ে উঠেছে। রমজান এলে বিভিন্ন জমকালো রেস্তোরাঁসহ অলিগলিতে ইফতারসামগ্রী বিক্রি করা হয়। অনেকে মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করেন টক-মিষ্টি জিলাপি। কিন্তু সেটি জাকির হোসেনের তৈরি টক-মিষ্টি জিলাপির সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে না। ফলে এখনো দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ঐতিহ্যের এই জিলাপি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে শহরে এসে চায়ের দোকানে কাজ নেন জাকির হোসেন। এক বছর পর নগরীর জিলা স্কুল মোড়ের হোটেল মেহেরবানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন দোকানটির মালিক ছিলেন নগরীর বাসিন্দা মইনুল হোসেন। ১৯৯২ সালের দিকে তিনি হোটেল চালাতে না পেরে জাকির হোসেনকে দায়িত্ব দেন। পরের বছর ঘিয়ে ভাজা টক-মিষ্টি জিলাপি তৈরি করেন তিনি। একদিন বৃষ্টির কারণে দোকানে ক্রেতা না আসায় জিলাপির জন্য প্রস্তুত করা ময়দা আর চিনি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। পরে তিনি ময়দার সঙ্গে তেঁতুলের টক আর মাসকলাই মিশিয়ে তৈরি করেন বিশেষ ধরনের জিলাপি। ক্রেতার অভাবে দোকানের অন্য কর্মচারীদের খেতে দেন সেই জিলাপি। সেগুলো খেয়ে অনন্য স্বাদ পাওয়া যায়। পরের দিনও এভাবেই জিলাপি বানিয়ে বিক্রি করলে ক্রেতারা জিলাপির প্রশংসা করেন। ধীরে ধীরে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যা এখনো চলছে। ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইফতারের আগে নিমিষেই খালি হয়ে যায় জিলাপির ডালা।
শহরে আকুয়া এলাকা থেকে টক-মিষ্টি জিলাপি কিনতে জাকির হোসেনের দোকানে এসেছেন প্রকৌশলী নাদিম পারভেজ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাসার সামনেই জিলাপিসহ ইফতারসামগ্রীর দোকান রয়েছে। তবে জাকিরের দোকানের টক-মিষ্টি জিলাপির সুনাম বহু বছরের। এই জিলাপির স্বাদও আলাদা। তাই প্রতিবছর জিলাপি হোটেল মেহেরবান থেকেই কিনি।’
Advertisement
বলাশপুর এলাকা থেকে আসা ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘অন্য সব জিলাপি থেকে এ জিলাপির স্বাদ আলাদা। জিলাপি চিবোতে শুরু করলেই পাওয়া যায় মচমচে, রসালো, টক-মিষ্টি একটা স্বাদ। যা খুবই ভালো লাগে। ফলে রমজান এলে এই দোকান থেকে জিলাপি নিয়ে যাই। পরিবারের সবাই একসঙ্গে ইফতারে মজা করে খাওয়া হয়।’
আরও পড়ুন: ১ টাকায় মিলছে চপ, জিভে জল আনে ১৪০০ টাকার কালাভুনাবাপ্পী মজুমদার জেলার গৌরীপুর উপজেলা থেকে শহরের কাচিঝুলি এলাকায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তিনিও জিলাপি কিনছিলেন। বাপ্পী বলেন, ‘বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। বাপ-দাদারাও বলে জেলার মধ্যে এই জিলাপি বিখ্যাত। এর আগে কয়েকবার এই দোকানে বসে জিলাপি খেয়েছি। অন্য জিলাপির চেয়ে স্বাদে ভিন্নতা রয়েছে।’
কথা হয় জাকির হোসেনের ছেলে আশিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজান এলে জিলাপি বিক্রির ধুম পড়ে। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী স্পেশাল টক মিষ্টি জিলাপি একচেটিয়া বিক্রি হয়।’
তিনি বলেন, ‘ক্রেতাদের চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। দোকানে ১৫ জন কর্মচারী কাজ করছেন। দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে থেকে জিলাপি কিনে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে ক্রেতাদের।’
বছরের অন্যান্য সময় প্রতিদিন প্রায় দুই মণ বিক্রি হলেও শুধু রমজান মাসে প্রতিদিন সাড়ে ৬ মণের বেশি জিলাপি বিক্রি হয়। এরমধ্যে প্রায় সবাই কেনেন ঘিয়ে ভাজা স্পেশাল টক-মিষ্টি জিলাপি। এই জিলাপির প্রতিকেজির মূল্য ৩৬০ টাকা।
আশিকুর রহমান আরও বলেন, ‘রোজার প্রথমদিন (২ মার্চ) প্রায় এক লাখ টাকার জিলাপি বিক্রি হয়েছে। পুরো রমজানে ৩০ লক্ষাধিক টাকার জিলাপি বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’
জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, টক-মিষ্টি জিলাপির প্রধান উপকরণ হলো মাসকলাই ডাল, ময়দা, চালের গুঁড়ার সঙ্গে তেঁতুল। প্রতিবারই জিলাপি ভাজতে নতুন তেল ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন দুপুর থেকেই গরম কড়াই থেকে ভাজা জিলাপি টেবিলের ডালায় সাজানো হয় থরে থরে। ইফতারের আগে নিমিষেই খালি হয়ে যায় জিলাপির ডালা।
তিনি বলেন, আজানের আগ পর্যন্ত ক্রেতাদের ভিড়ের কারণে অনেকে সিরিয়াল না পেয়ে জিলাপি কিনতে পারেন না। তারা আশপাশের বিভিন্ন দোকান থেকে কিনে বাড়ি ফেরেন। সুশৃঙ্খলভাবে বিক্রি করতে আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। স্বাদ ধরে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এসআর/জেআইএম