অর্থনীতি

টিসিবির পণ্যের জন্য হাহাকার

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে দিশাহারা সবাই। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির ট্রাকসেলের লাইনে দাঁড়ান অনেক মানুষ। ভোর থেকেই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে ট্রাকসেলে সাশ্রয়ী দামে পণ্যের আশায় নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড় শুরু হয়।

Advertisement

টিসিবির এসব ট্রাকসেল থেকে ফ্যামিলি স্মার্ট কার্ড ছাড়াও ২০০ মানুষকে পণ্য দেওয়া হয়। তবে সেখানে বাস্তবতা ভিন্ন পরিলক্ষিত হয়। মানুষের উপস্থিতি এত বেশি থাকে যে হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি ও মারামারির ঘটনাও ঘটে। এর মধ্য থেকে যারা পণ্য পান তার চোখ-মুখে একচিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কিন্তু ট্রাকের সামনে লম্বা লাইনে যে পরিমাণ মানুষ থাকে তাদের বেশিরভাগই ফেরেন খালি হাতে। বিশেষ করে বয়স্ক ও শারীরিকভাবে দুর্বল মানুষেরা পণ্য পাওয়ার তালিকায় থাকেন না।

মঙ্গল (২৫ ফেব্রুয়ারি) ও বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে টিসিবির ট্রাকসেলের সামনে এমন চিত্র দেখা যায়। দুদিনে ১০টি জায়গায় টিসিবির বিক্রয় কার্যক্রম ঘুরে দেখেছেন এই প্রতিবেদক।

আরও পড়ুন

Advertisement

রোজায় ঢাকার বাইরেও টিসিবির ট্রাক সেলে মিলবে চাল-ডাল-তেল পুরো রমজানে টিসিবির ট্রাকসেল চালু থাকবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা টিসিবির কার্ড বাতিলে ভোগান্তিতে অর্ধলাখ মানুষ

সরেজমিনে দেখা যায়, আসন্ন রমজান মাস ঘিরে টিসিবির পণ্যের প্রতি নিম্ন আয়ের মানুষের আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ একেবারেই কম। বিভিন্ন এলাকায় টিসিবির গাড়ি এসে দাঁড়ানোর আগেই প্রায় প্রতিটি ট্রাকের পেছনে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের লম্বা সারি হয়। জনবহুল আবাসিক এলাকায় মানুষের সংখ্যা আরও বেশি থাকে।

এর মধ্যে ২০০ মানুষকে টোকেন বিতরণ করে পরে পণ্য দেওয়া হয়। যদিও বিক্রি কার্যক্রম চলা ওই দু-তিন ঘণ্টায় আরও কয়েকশ মানুষ পণ্য নিতে এসে আশাহত হয়ে ফিরে যান। সব মিলিয়ে বরাদ্দের চেয়ে পণ্য নিতে মানুষের সংখ্যা এলাকাভেদে দ্বিগুণ থেকে চারগুণ হয়।

দুদিনে রামপুরা, মালিবাগ, মৌচাক, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণির একাধিক স্থান ও একাধিকবার বিক্রি কার্যক্রম পরিদর্শনে দেখা যায়, টিসিবির ট্রাকের পেছনে দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য পাননি কেউ কেউ। আবার অনেকে আগে এলেও ট্রাক আসার সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলিতে টিকতে পারেন না। অনেকে লাইনে থাকলেও বিশৃঙ্খলার কারণেও টোকেন পান না। অবশেষে পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যান অনেকে।

‘বাজারে তেল পাওয়া যায় না, অন্য সব জিনিসের দামও চড়া। এখানে (টিসিবিতে) এসব পণ্য অর্ধেক দামে দেওয়া হয়। সেজন্য পণ্য নিতে একরকম যুদ্ধ শুরু হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। মারামারিও হয় অনেক এলাকায়। আসলে যত মানুষ আসেন তারচেয়ে বরাদ্দ অনেক কম।’ টিসিবির ডিলার আদ্রিক ইন্টারন্যাশনালের পলাশ উদ্দিন

Advertisement

টিসিবি থেকে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি করে মসুর ডাল ও ছোলা, এক কেজি চিনি এবং ৫০০ গ্রাম খেজুর কিনতে পারছেন। প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম রাখা হয় ১০০ টাকা। প্রতি কেজি চিনি ৭০ টাকা, মসুর ডাল ও ছোলা ৬০ টাকা করে কেজি এবং খেজুর ১৫৬ টাকা। যেখানে বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ২০০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ১২৫ টাকা, মসুর ডাল ও ছোলা ১২০ টাকা এবং খেজুর ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ টিসিবির একটি প্যাকেজ পেলে সাধারণ মানুষের অর্ধেকের বেশি সাশ্রয় হয়। মূলত এই অর্থ সাশ্রয়ের জন্যই তীব্র ভিড় সত্ত্বেও মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন।

চাহিদা প্রসঙ্গে টিসিবির ডিলার আদ্রিক ইন্টারন্যাশনালের পলাশ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে তেল পাওয়া যায় না, অন্য সব জিনিসের দামও চড়া। এখানে (টিসিবিতে) এসব পণ্য অর্ধেক দামে দেওয়া হয়। সেজন্য পণ্য নিতে একরকম যুদ্ধ শুরু হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। মারামারিও হয় অনেক এলাকায়। আসলে যত মানুষ আসেন তারচেয়ে বরাদ্দ অনেক কম।’

‘এত মানুষ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। বিশৃঙ্খলা এড়াতে টোকেন দেওয়া হচ্ছে স্থানীয়দের সহায়তায়। তারপরও অনেক ঝামেলা হয়। টোকেন নেওয়ার জন্য গন্ডগোল ও চাপ তৈরি করছে কিছু মানুষ।’- কারওয়ান বাজারে ডিলারের প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম

বুধবার কারওয়ান বাজারে টিসিবির পণ্য বিক্রি করছিলেন ডিলার আবদুর রহমান স্টোরের কর্মচারীরা। এখানে ট্রাক আসে বেলা ১১টায়। ট্রাক পৌঁছার আগেই সেখানে প্রায় দেড় থেকে ২০০ মানুষ ছিল। দুপুর ২টার দিকে ট্রাকের পণ্য বিক্রি শেষ হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত অন্তত ১০০ জন মানুষ পণ্য কিনতে না পেরে খালি হাতে ফিরে যায়। এছাড়া পণ্য বিক্রির সময় আরও কয়েকশ মানুষ এসে লাইন বড় দেখে ফিরে যায়। এ চিত্র শুধু কারওয়ান বাজারে নয়, সবখানেই।

সেখানে ডিলারের প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এত মানুষ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। বিশৃঙ্খলা এড়াতে টোকেন দেওয়া হচ্ছে স্থানীয়দের সহায়তায়। তারপরও অনেক ঝামেলা হয়। টোকেন নেওয়ার জন্য গন্ডগোল ও চাপ তৈরি করছে কিছু মানুষ।’

টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, রমজানজুড়ে ঢাকা ও দেশের বিভাগীয় শহরসহ বিভিন্ন স্থানে এভাবে ট্রাকসেলে ১২ লাখ পরিবারের মধ্যে পণ্য বিক্রি করা হবে। এছাড়া টিসিবির নিয়মিত উপকারভোগী ৫৭ লাখ স্মার্ট কার্ডধারী পরিবার ভর্তুকি মূল্যে পণ্য পাবে। স্মার্ট কার্ডে পণ্য বিক্রিতে কিছুটা শৃঙ্খলা থাকলেও ট্রাকসেলে যে কেউ পণ্য নিতে পারেন বলে বিশৃঙ্খলা বেশি। টিসিবির নিবন্ধিত ডিলার বা সরবরাহকারীরা ট্রাকে প্রতিদিন ঢাকা শহরের ৫০টি স্থানে পণ্য বিক্রি করেন।

‘আমাগো গায়ে জোর নাই। তিনদিন ধরে ঘুরছি, ধাক্কাধাক্কি করে সিরিয়াল নিতে পারিনি।’- মৌচাকে সত্তরোর্ধ্ব সাফিয়া বেগম

দেখা গেছে, টিসিবির এসব ট্রাকের পেছনে নারী ও পুরুষরা সাধারণত দুটি সারিতে দাঁড়ান। যিনি আগে আসবেন তিনি লাইনের সামনে থাকবেন- নিজেদের মধ্যে এমন সমঝোতায় সবাই ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করেন আগে থেকেই। কিন্তু ট্রাক এসে দাঁড়ানোর পরে এ শৃঙ্খলা থাকে না। কারণ ট্রাকের সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে আসেন শতাধিক মানুষ। এরপর আগে ও পরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে শুরু হয় হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলি। এরপর ডিলারের কর্মচারীরা উপস্থিত মানুষের মধ্যে টোকেন বিতরণ করেন। অনেক ক্রেতা আগে পণ্য নেওয়ার জন্য লাইন ভেঙে সামনে চলে যান টোকেন নিতে। তাতেই শুরু হয় হট্টগোল।

এসব হুড়োহুড়িতে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়েন বয়স্ক ও শারীরিকভাবে দুর্বল মানুষেরা। মৌচাকে সত্তরোর্ধ্ব সাফিয়া বেগম বলেন, ‘আমাগো গায়ে জোর নাই। তিনদিন ধরে ঘুরছি, ধাক্কাধাক্কি করে সিরিয়াল নিতে পারিনি।’

ওই সময় সাফিয়া বেগমের সঙ্গে থাকা কয়েকজন জানান, অনেকের আগে এসেছিলেন সাফিয়া।

আরও পড়ুন

রমজানের আগে পণ্যের দাম স্থিতিশীল, সংকট কাটেনি ভোজ্যতেলে আর কত আমদানি হলে বাজারে সয়াবিন তেল মিলবে? যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই সয়াবিন তেলের সংকট

সেখানে আবুল হোসেন নামের আরেকজন বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, ‘গাড়ি আসার আগে ২০ থেকে ২২ জনের পেছনে ছিলাম। এরপর যখন টোকেন দিলো তখন ৭৬ নম্বর সিরিয়াল পেলাম। এ কারণে বুঝতেও পারছি না যে শেষ পর্যন্ত পণ্য পাবো কি না।’

এদিকে প্রতিটি স্থানেই পণ্য বিক্রি কার্যক্রমে নারীদের লাইনে চরম বিশৃঙ্খলা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা প্রকট। কারওয়ান বাজারে হাতাহাতি করা দুই নারীর মধ্যে মরিয়ম নামের একজন জানান, টোকেন নেওয়ার সময় পেছন থেকে এক নারী তাকে ধাক্কা দিয়ে টোকেন নিয়ে নেন। সে কারণে মরিয়ম টোকেন পাননি। ওই নারী দল বেঁধে এসে এমন বিশৃঙ্খলা করেন। এরা একটি গ্যাং বলেও অভিযোগ করেন মরিয়ম।

‘যারা টোকেন দেন তারাও স্বজনপ্রীতি করেন। তাদের অনেক পরিচিত লোক থাকে লাইনে, তাদের আগের সিরিয়াল দেন।’- টিসিবির পণ্য নিতে আসা সুমি

ওই সময় মরিয়ম ও একাধিক নারীর মধ্যে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট ঝগড়ার পর হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে কয়েকজন তাদের থামিয়ে আলাদা করেন।

সেখানে ডিলারের এক প্রতিনিধি জানান, মানুষের ভিড় বেশি থাকায় বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে তাদের কথা শোনেন না।

সুমি নামের এক নারী অভিযোগ করে বলেন, ‘যারা টোকেন দেন তারাও স্বজনপ্রীতি করেন। তাদের অনেক পরিচিত লোক থাকে লাইনে, তাদের আগের সিরিয়াল দেন।’ তার অভিযোগ সকাল ৮টায় এসে তিনি লাইনে দাঁড়ান। কিন্তু গাড়ি আসার পর ধাক্কাধাক্কি করে লাইন থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে লাইনের একদম পেছনে দেওয়া হয়েছে তাকে।

আরও পড়ুন

আয়-ব্যয়ে অসংগতি, দিন পার করতে নাভিশ্বাস টিসিবির পণ্যের দাম বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানো সম্ভব গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক-অবাস্তব: মোহাম্মদ হাতেম

এদিকে ডিলার ও তাদের কর্মীদের মধ্যে যারা টোকেন বিতরণ করেন তারা ক্রেতাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ করেন অনেকে। বাস্তবেও তেমনটি ঘটে। পণ্য নিতে আসা ক্রেতাদের গালাগাল যেন নিয়মিত ঘটনা। আবার ক্রেতাদের মধ্যেও সজোরে ধাক্কা দেওয়া, গালাগালি বলতে গেলে সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এনামুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘এ পরিবেশে যারা সভ্য মানুষ তারা থাকতে পারবেন না। আর কোনো ভদ্র নারীও আসবেন না। যারা আসছেন, তারা বাধ্য হয়ে এসেছেন।’

এত কিছুর পরও যারা পণ্য পাচ্ছেন তাদের মুখে হাসি দেখা গেছে। পণ্য পেয়ে নাছিমা আক্তার নামের একজন বলেন, ‘এত কষ্ট হইলেও জিনিসগুলো পাইছি। বাজারে কিনতে গেলে কত টাকা লাগতো। হয়তো কিনতে পারতামই না। এখন আর রোজার বাজার নিয়ে চিন্তা থাকলো না।’

এনএইচ/ইএ/এমএমএআর/এমএস