জাতীয়

গোলাপি বাসের কাউন্টার স্থাপনে সহযোগিতা করছে না সিটি করপোরেশন

রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ই-টিকেটিং পদ্ধতির গোলাপি বাস চালু করেছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সপ্তাহ না গড়াতেই মুখ থুবড়ে পড়ছে এ সেবা। চলছে যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা। অনেক স্থানে দেখা মিলছে না টিকিট কাউন্টারের। চালকেরা আগের মতো চুক্তিতেই গাড়ি চালাতে চান।

Advertisement

এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মুসা আহমেদ।

জাগো নিউজ: নগরে গোলাপি বাসের নবযাত্রা যাত্রীদের মনে স্বস্তি এনেছিল। সাত দিন না যেতেই আগের মতো যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা চলছে। এর কারণ কী?

সাইফুল আলম: গত ১৯ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে তার নিজ দপ্তরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সড়কে শৃঙ্খলা, ঢাকা মহানগরে যানজট নিরসন ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয়। পরে বাস মালিকদের সঙ্গে চালকের ট্রিপভিত্তিক চুক্তি না করে পাক্ষিক বা মাসিক ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন করতে নির্দেশনা দেন উপদেষ্টা। সে নির্দেশনার আলোকেই গত ৬ ফেব্রুয়ারি উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যের বাসে টিকিট কাউন্টার এবং ই-টিকেটিং পদ্ধতি চালু হয়।

Advertisement

গোলাপি বাসে টোটালি সমস্যার সমাধান করতে এক থেকে দেড় মাসের মতো সময় লাগবে। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে গাড়ি রং করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিকভাবে আমরা জোর দিয়েছে নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রী বাসে ওঠানো বা টিকিট বিক্রি নিয়ে

আমরা সবাই অনিয়মে চলতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যার কারণে নগরে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। আবার অহরহ দুর্ঘটনাও ঘটে। এতে পুরো পরিবহনখাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টা আমরা সবাই স্বীকার করি। এটাকে শৃঙ্খলায় আনতে হলে, যানজট নিরসন করতে হলে সবাইকে দায়িত্বের সঙ্গে ধৈর্য নিয়ে কাজ করতে হবে। যদিও বাস্তবে আমরা যেটা দেখলাম, সড়কের শৃঙ্খলা আনা এটা অনেক কঠিন কাজ। এখন আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যে ২৬১০টি বাস চলে। এ বাসগুলো দিয়ে আমরা কাউন্টার ও টিকেটিং পদ্ধতি চালু করেছি। সবগুলো বাস গোলাপি করার কাজ চলছে। তবে সব বাস একসঙ্গে গোলাপি রং করা সম্ভব হয়নি। কয়েক ধাপে রঙের কাজ চলছে।

আবার বাস মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে মজুরি মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। শ্রমিকেরা চাচ্ছেন চুক্তিতে গাড়ি চালাতে। এতে তারা সড়কে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করতে পারবেন। অন্যদিকে আমরা মালিকেরা চাই ট্রিপ পদ্ধতিতে (দূরত্ব অনুযায়ী চালকের মজুরি) বাস চালাতে। এ নিয়ে দুই পক্ষকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আমরা মনে করি ৫০ শতাংশ এগোতে পেরেছি। পুরো পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতে একটু সময় লাগবে। সবার সহযোগিতা পেলে আমরা তার বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবো।

সিটি করপোরেশন তো কোনো দায়িত্বই নিচ্ছে না। এখন আমরা নিজেরা যদি বাস স্টপেজের সাইন লাগাতে যাই, সেগুলো কিন্তু সিটি করপোরেশন আবার উঠিয়ে দেবে। আবার তাদেরও অনুমোদন লাগবে। তারপরও আমরা সিটি করপোরশনকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই

Advertisement

জাগো নিউজ: গোলাপি বাসের জন্য কাউন্টার ও টিকেটিং পদ্ধতির কথা বলছেন। অথচ বাস্তবে নগরের তেমন কোথাও তা দেখা যাচ্ছে না কেন?

সাইফুল আলম: সাধারণত বাস বে, বাসস্ট্যান্ড, যাত্রী ছাউনি, টিকিট কাউন্টারের জায়গা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন করে দেওয়ার কথা। কিন্তু এ দুটি সংস্থা আমাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করছে না। এ বিষয়ে বারবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাচ্ছি না। অথচ গোলাপি বাস চালুর আগে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের লোক এনে আমরা কোথায় কোথায় বাস থামবে তা নির্ণয় করেছি।

আরও পড়ুন সাত দিনেই সব নিয়ম ভেঙে আগের রূপে গোলাপি বাস  ঢাকায় ২৬১০ বাসে করা হচ্ছে গোলাপি রং  টিকিট কেটে উঠতে হবে, যত্রতত্র ওঠানামা করা যাবে না 

আমরা নিজেরা কোথাও কাউন্টার স্থাপন করতে গেলে দেখা যায়, মহল্লার লোকজন, মার্কেটের ব্যবসায়ী, হকাররা বাধা দেয়। আমাদের কাউন্টারের লোকদের মারধর করা হয়েছে। আবার যাত্রী এখনো যত্রতত্র হাত তুলছেন। এ কারণে গোলাপি বাসের টিকিট পদ্ধতি গোছাতে একটু সময় লাগছে। তারপরও যাত্রীদের অনুরোধ করেছি তারা যাতে নির্দিষ্ট বাস স্টপেজে গিয়ে বাসে ওঠেন।

জাগো নিউজ: সম্প্রতি চুক্তিতে বাস চালাতে ঢাকার কয়েক জায়গায় আন্দোলন করেছেন চালকরা। তাদের দাবিটি কীভাবে দেখছেন?

সাইফুল আলম: যেসব পরিবহন শ্রমিক চুক্তিতে গাড়ি চালিয়ে অনেক লাভবান হয়েছেন তারা টিকেটিং পদ্ধতিতে আসতে চান না। তারা সড়কে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। অথচ তাদের ট্রাফিক না মানার প্রবণতা সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি। বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করছি।

আবার দেখা গেলো এক জায়গায় শ্রমিকদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, অন্য জায়গায় আন্দোলন শুরু হয়েছে। তাই একে একে সব রুটের চালকদের কাউন্সিলিং করছি। এক কথায় এই অসহযোগিতা এবং অনিয়ম দূর করার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এই শহরে পরিবহনে শৃঙ্খলা আনাটা জরুরি।

আমরা একটা নিয়মে আসতে পারি। এটা খুবই সিম্পল। যেমন, কাউন্টারে গাড়ি দাঁড়াবে, যাত্রী টিকিট কেটে বাসে উঠবেন। এখানে চালকের সঙ্গে মালিকের কন্ট্রাক্ট বলে কিছু থাকবে না। শ্রমিকদেরও তাদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে আমরা খুবই কনসার্ন। কোনো শ্রমিককে যাতে ঠকানো না হয়। মালিকও যেন তার প্রাপ্য অংশটুকু পায়। এ নিয়মে চললে পরে শহরে চলাচলের গতি বেড়ে যাবে। কেউ অযথা যাত্রী তোলা নিয়ে কম্পিটিশনে যাবে না। এতে দুর্ঘটনা ও যানজট কমবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আয়ও বেড়ে যাবে।

কারণ তখন ট্রিপ বেড়ে যাবে। নগরবাসীর মধ্যে একটি স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। যদিও অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, আগে কন্ট্রাক্ট সিস্টেমে নগরে বাস চলতো। অর্থাৎ, চালক সারাদিন বাস নিজের মতো করে পরিচালনা করবে, দিনশেষে সে মালিককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেবে। এ নিয়মে বেশি টাকা উপার্জনের জন্য ট্রাফিকের নিয়ম মানতো না চালকেরা। এজন্য চালকদের অনেক কাউন্সিলিং করেছি। এখন তারা তা বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন।

জাগো নিউজ: গোলাপি বাস চালুর পর সড়কে বাসের সংখ্যা কমেছে। অনেক মালিক সড়কে বাস নামাচ্ছেন না। এর কারণ কী?

সাইফুল আলম: বাস কিছু কম হওয়ার কারণ হলো, আগে আব্দুল্লাহপুর থেকে যেসব বাস চলতো তাদের অনেকেরই ফিটনেস নেই। আবার বাস দেখতে আনফিট, কিন্তু কাগজপত্র ঠিক আছে। আমরা সেসব গাড়ি টার্গেট করেছি। যেসব গাড়ির ইন্ডিকেটর নেই, গ্লাস নেই, রংচটা সেগুলো সড়কে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে ১০ থেকে ২০ শতাংশ গাড়ি চলছে না। আবার আব্দুল্লাহপুর রুটের বাসগুলো কয়েক ধাপে রং করাচ্ছি। একেকটি বাস রং করে নতুন করে সাজাতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। এ কারণে সড়কে কিছু গাড়ি কম। যদিও সকালে অফিস সময়ে সড়কে এমনিতেই যাত্রী বেশি থাকে। তখন মনে হয় সড়কে বাসের সংখ্যা কম।

জাগো নিউজ: গোলাপি বাস নিয়ে এখন যে সংকট চলছে তা কতদিন পর্যন্ত চলতে পারে?

সাইফুল আলম: গোলাপি বাসে টোটালি সমস্যার সমাধান করতে এক থেকে দেড় মাসের মতো সময় লাগবে। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে গাড়ি রং করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিকভাবে আমরা জোর দিয়েছে নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রী বাসে ওঠানো বা টিকিট বিক্রি নিয়ে।

জাগো নিউজ: গোলাপি বাস চালুর আগে প্রস্তুতিতে আপনাদের কোনো ঘাটতি ছিল কি না?

সাইফুল আলম: পরিবহন খাতের সমস্যা একদিনের নয়। আমি পরিবহন খাতের পুরোনো ব্যবসায়ী। এসব সমস্যা সমাধানের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। কিন্তু সিটি করপোরেশন, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ তা সমাধানের চেষ্টা করেনি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন তো কোনো দায়িত্বই নিচ্ছে না। এখন আমরা নিজেরা যদি বাস স্টপেজের সাইন লাগাতে যাই, সেগুলো কিন্তু সিটি করপোরেশন আবার উঠিয়ে দেবে। আবার তাদেরও অনুমোদন লাগবে। তারপরও আমরা সিটি করপোরশনকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

জাগো নিউজ: ঢাকার গণপরিবহনে প্রশিক্ষিত চালক তৈরিতে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কোনো উদ্যোগ আছে কি না?

সাইফুল আলম: পরিবহন খাতে শৃঙ্খলায় সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন চালকেরা। এরা আভিধানিকভাবে ট্রাফিক জ্যাম সম্পর্কে জানে না, যতটুকু জানে তা দিয়েই চলছে। এক্ষেত্রে আমাদের দক্ষ চালক সংকট রয়েছে। তবে গাড়ি তো চলতে হবে, মানুষ তো যাতায়াত করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি।

জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সাইফুল আলম: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ

এমএমএ/এএসএ/জিকেএস